কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি-বিজড়িত বোলপুর, শান্তিনিকেতন। এই দুই জায়গাকে ঘিরে লুকিয়ে রয়েছে রবি ঠাকুরের বহু ইতিহাস। বেশ লাগে এই লাল মাটিতে ঘুরতে। এখানে রয়েছে সোনাঝুরি, শালবীথি, প্রান্তিক, খোয়াই, কোপাই, বিশ্বভারতী আর কালোর চায়ের দোকান। অনেকেই হয়তো বহুবার গিয়েছেন বোলপুর, শান্তিনিকেতন। কিন্তু আপনারা কি কোনদিনও ঘুরে দেখেছেন কালোর চায়ের দোকান? অনেকেই হয়তো ভাবছেন চায়ের দোকান এখানে আবার দেখার কী আছে! তবে এই দোকানের মধ্যে লুকিয়ে আছে অনেক অজানা ইতিহাস।
শান্তিনিকেতনের রতন পল্লীর বেশ ভিতর দিকে অবস্থিত ‘কালোর চায়ের দোকান’। একসময় সকালে এবং রাতে রোজ নিয়ম করে চা বিক্রি হত এই দোকানে। চা বলতে শুধু লিকার চা। আর মাঝে মাঝে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী লেবু চা। সত্যি বলতে কয়েকটি বেঞ্চ আর টেবিল না থাকলে এটিকে চায়ের দোকান বলে বোঝাই যেত না। কারণ এখানে বসবাস যোগ্য দুটি ঘর রয়েছে। কিন্তু সেখানে কেউ বাস করে না। দীর্ঘদিনের পুরনো বলে এখন ঘরগুলির ভিতর গেলেই চোখে পড়বে জীর্ণতার ছাপ। তবে দুটি ঘরেই বিদ্যমান প্রবীণতার নানান বৈশিষ্ট্য। এটিই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় ‘কালোর দোকান’। একসময় রামকিঙ্কর বেজ, নন্দলাল বসু, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখেরা ছিলেন এই দোকানের নিয়মিত খদ্দের।
১৯১৮ সালে শান্তিনিকেতন আশ্রমে যাত্রা শুরু করেছিল ‘কালোর দোকান’। ওই আশ্রমে রবি ঠাকুরের বৈঠকে চায়ের যোগান দিতেন কালিপদ দলুই ওরফে কালো। তিনি ছিলেন ভুবনডাঙার বাসিন্দা। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি সিংহল ভ্রমণও করেছেন বলে জানা যায়। কবিগুরুর নির্দেশেই তিনি আশ্রমের মধ্যেই খোলেন চায়ের দোকান। দেশ-বিদেশ থেকে রবি ঠাকুরের কাছে আসা বহু গুণীজনদের তৃপ্তি দিয়েছে এই ‘কালোর চা’। এমনকি জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকেও কবিগুরু এই দোকানের চা খাইয়েছিলেন। এখনও সেই ছবি ফ্রেমবন্দি হয়ে রয়েছে কালোর দোকানের একটি ঘরে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় চালু হওয়ার পর ১৯৫২ সালে এই দোকানটি আশ্রম থেকে রতন পল্লীতে স্থানান্তরিত হয়। তবে এখন কালিপদ বাবু পাড়ি দিয়েছেন পরপারে। কালিপদ বাবুর বড় ছেলে মদন মোহন দলুই এই দোকানটি চালান।
বর্তমানে রতনপল্লীতে কালো’দার নামের দোকান আজও আছে, তবে সেটা ধ্বংসাবশেষ। কালিপদবাবুর নাতি অমিত দলুইয়ের থেকে জানা যায়, গত তিন বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী ‘কালোর চায়ের দোকান’ বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। তিনি ২০০৬ সাল পর্যন্ত বোলপুরের পৌষ মেলায় এই দোকানের স্টল খুলেছিলেন। কিন্তু কাজের ব্যস্ততায় তা আর চালু রাখা সম্ভব হয়নি। এই দোকানের সঙ্গে শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে। তাই তিনি চান কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার, বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ অথবা যে কোনও সংস্থা নিজেদের প্রয়াসে তাদের এই দোকানটি চালু করুক।
চিত্র ঋণ – বিকাশ দাস
Discussion about this post