বাঙালির রসনাতৃপ্তির জন্য খাবার পাতে সুগন্ধি সরু চালের ভাত লাগবেই। শুধু বাঙালি নয়, ভারতের সর্বত্রই সরু আর সুগন্ধি চালের চাহিদা রয়েছে। বিরিয়ানি বা পোলাও কিংবা বাড়ির সাদা ভাতই হোক না কেন, সুগন্ধি চালের কদর অনস্বীকার্য। হোটেল-রেস্তোরাঁতেও এই সুগন্ধি চাল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তুলাইপাঞ্জি, গোবিন্দভোগ, কালোনুনিয়া, রাঁধুনিপাগল, কাটারিভোগ, বাদশাভোগ, রাধাতিলক ইত্যাদি বাহারি নাম তাদের। কিন্তু শুধু ভাতের পাতে নয়, বাংলার অন্যান্য অনেক বিখ্যাত খাবারের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে সুগন্ধি চাল উৎপাদনের ইতিহাস। যেমন কনকচূড় চাল।
সনাতন কৃষি পদ্ধতিতে ভারতে উৎপাদিত ধান ছিল আমন, আউশ এবং বোরো। কৃষির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে বিভিন্ন প্রজাতির সংকর ধান চাষ হয়েছে। সুগন্ধি চালগুলি তেমনই সংকর প্রজাতির ধান থেকে উৎপাদিত। তার মধ্যে কনকচূড় একটি অন্যতম সরু চালের সুগন্ধী ধান। এই ধানটির চাষ মূলত সীমাবদ্ধ দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জয়নগর, কুলতলি, মথুরাপুর, কুলপি প্রভৃতি অঞ্চলে। কনকচূড়ের বাণিজিক মূল্য সুগন্ধি ভাতের জন্য নয়, বরং সুগন্ধী খইয়ের জন্য। পশ্চিমবঙ্গের প্রসিদ্ধ মিষ্টি ‘মোয়া’-র মূল উপাদান এই কনকচূড়ের খই। মোয়া মিষ্টির কারিগরদের বাস দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জয়নগর অঞ্চলে। তাই এই চালের চাষ এই জেলাতেই কেন্দ্রীভূত। তবে মোয়া ছাড়াও খই-এর বিবিধ ব্যবহারের জন্য কনকচূড়ের সুগন্ধী খই জনপ্রিয়।
চিটেমুক্ত শুকনো ধান লোহার কড়ায় বালির ওপর ফেলে ভাজা হয়। অনবরত নাড়তে নাড়তেই ধানের খোসা থেকে বেরিয়ে আসে খই। বর্তমানে খই তৈরির মেশিন বেরোলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খই এখনও গ্রামেগঞ্জে বালি খোলাতে ভেজে তৈরি হয়। উত্কৃষ্ট খই বানানোর জন্য নির্দিষ্ট কিছু ধানের জাত চাষ করা হয়ে থাকে। যেভাবে সুগন্ধি খইয়ের জন্য চাষ করা হয় কনকচূড় ধান।
মোয়ার সিজন শুরুর আগে ব্যবসায়ীরা কনকচূড় চাল নিয়ে এসে মোয়া তৈরি করেন। সম্প্রতি আবহাওয়ার জন্য কনকচূড় ধানের চাষে সমস্যা হয়েছে। ফলে, বাজারে কনকচূড়ের ঘাটতি হয়েছে। অনেক ব্যবসায়ীরা অন্য ধানের খই দিয়ে মোয়া তৈরি করছেন। আজ অনেক ক্ষেত্রে জয়নগরের মোয়া তৈরি হয় স্বর্ণ বা আই-আর ৩৬ চাল দিয়ে। বাজারে অনেক সুগন্ধি চালই প্রাকৃতিক হয় না, তাতে কৃত্রিমভাবে সুগন্ধ যোগ করা থাকে। তবে মোয়ার গুণগত মান নির্ভর করে কনকচূড় ধানের উপরেই। আগের বছরেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা প্রশাসন কনকচূড় ধানের চাষ বাড়িয়ে মোয়া উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছিল। এমন অনেক চালও আছে যার উৎপাদনই বন্ধ হয়ে গেছে বর্তমানে। তবে সুগন্ধি চালের কদর বাড়লেও ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যোগান দেওয়া আজও দুষ্কর।
Discussion about this post