গুপ্তিপাড়ার রথ, যা আসলে ভারতবর্ষের প্রাচীন ঐতিহ্যের গল্প বলে। গুপ্তিপাড়ার রথের প্রাচীন গল্পের নতুনত্বই তাকে করে তুলেছে দেশের অন্যান্য রথযাত্রা থেকে আলাদা। গুপ্তিপাড়ার রথ সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ ভান্ডার লুটকে কেন্দ্র করে। আবার এই ভান্ডার লুট নিয়েও রয়েছে নানা ধরনের গল্প। চলুন সেই গল্পই খুলে বলা যাক।
শোনা যায় একবার জগন্নাথ দেব লক্ষ্মীর সঙ্গে মন কষাকষি করে লুকিয়ে মাসির বাড়িতে চলে আসেন। সেখানে এসে মাসির হাতের ভাল-মন্দ খাবার খেয়ে সে এতই খুশি হন, আর বাড়ি যাওয়ার নামই করেন না। এদিকে লক্ষী তো পড়েছেন মহা ফ্যাসাদে। কোথায় আছে তার প্রভু ভেবে ভেবেই তার দিন কাটছে। কখনও মনে হচ্ছে যে কেউ তার প্রভুকে তুকতাক করেনি তো? কিংবা জগন্নাথদেব পরকীয়া করতে অন্য কোথাও চলে যান নি তো? এমন সময় খোঁজ করতে করতে সে বৃন্দাবনের কাছে জানতে পারে যে, জগন্নাথদেব লুকিয়ে তাঁর মাসির বাড়িতে। স্বামীকে ফিরিয়ে আনতে পঞ্চমীর দিন লক্ষ্মী মাসির বাড়ির দরজায় সরষে পোড়া ছিটিয়ে দিয়ে আসেন। কিন্তু তাতে কোন কাজই হলোনা। নবমী পেরিয়ে গেলেও ফেরার নাম নেই জগন্নাথের। এমন অবস্থায় লক্ষ্মী খবর পাঠায় দুই ভাই বৃন্দাবনচন্দ্র আর কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে। ঠিক হয় একমাত্র ওই সব সুস্বাদু খাবার যদি সরিয়ে নেওয়া যায় তাহলেই জগন্নাথ দেবের হুঁশ ফেরানো যাবে। যেমন কথা তেমনি কাজ।
উল্টোরথের আগের দিন দুপুরে দুই ভাই লেঠেল জড়ো করে হুকুম দিলেন, জগন্নাথের খাবার ঘর মানে ভাণ্ডারা লুঠ করে নিতে। তারাও যথা সময়ে রওনা দিলেন মাসির বাড়িতে। সেখানে গিয়ে তারা দেখেন যে ঘরের তিনটি দরজা বন্ধ। দরজা ভেঙে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করেই তারা দেখতে পান মালসায় করে রকমারি পদের খাবার সাজানাে রয়েছে। ভাল ভাল খাবার চোখের সামনে দেখে তারা সেই সমস্ত মালসা লুট করে নেন। ব্যস আর কী, খাবার না পেয়ে হুঁশ ফিরল জগন্নাথ দেবের। তিনি বুঝতে পারলেন অভুক্ত অবস্থায় আর মাসির বাড়িতে থাকা যাবে না। পরের দিন উল্টো রথে সোজা গিয়ে হাজির হলেন লক্ষ্মীর কাছে। আবার এই গল্প নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। অনেকে বলেন, বৃন্দাবন চন্দ্রর প্রচুর ধনসম্পত্তি ছিল। তাই মন্দির চত্বর পাহারা দেবার উপযুক্ত লোক জোগাড় করার জন্য তিনি এই লুটের আয়োজন করতেন। যারা বেশি সংখ্যায় ভাণ্ডার লুট করতে পারত তারাই হত সবচেয়ে বেশি শক্তিমান। তাদের বৃন্দাবন চন্দ্র তার মন্দির পাহারার দায়িত্বে নিয়ােগ করতেন।
এই প্রাচীন প্রথা মেনে এখনও প্রতি বছর জগন্নাথের মাসির বাড়িতে গোবিন্দ ভোগ চালের খিচুড়ি, বেগুন ভাজা, কুমড়ো ভাজা, ছানার রসা, পায়েস, ক্ষীর, ফ্রায়েড রাইস, মালপোয়া, সন্দেশ ও রাবড়ি সহ মোট ৫২টি পদের প্রায় ৪৯ কুইন্টাল খাবার প্রস্তুত করা হয়। তারপর তা রাখা হয় ৫৫০ টি মালসায়। প্রতিটি মালসায় প্রায় ৫ থেকে ৮ কেজি করে খাবার থাকে। এই খাবার রান্না করার দায়িত্বে থাকেন ১০ জন রাঁধুনি ও ১০ জন সাহায্যকারী সহ মােট ২০ জন। নিয়ম মেনে দুপুর দুটোর আগেই সমস্ত খাবার তৈরি করে মালসায় সাজিয়ে রাখা হয়। বিকেল ৩ টায় মাসির বাড়ির দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর স্থানীয় ঘোষেরা (গোয়ালা) করেন এই লুঠ। অবশ্য তাঁরা রবীনহুড। লুঠ করা প্রসাদের সবটাই নিজেদের পেটে চালান করে দেন না। অসংখ্য দর্শনার্থীদেরও হাতে হাতে সেই ভোগ বিলিয়েও দেওয়া হয়। যা বহুল প্রচলিত ‘ভান্ডার লুট’ নামে পরিচিত।
প্রতিবছর নিয়ম মেনে নিষ্ঠার সঙ্গে জগন্নাথ দেবের মাসির বাড়িতে এই অনুষ্ঠান পালিত হয়। এটি দেখতে প্রতি বছর রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে ভিড় জমায় মানুষ। যদিও এ বছর করোনা সংক্রমণের জন্য ভান্ডার লুট অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে আসছে বছর আবারও ফিরে আসবে ‘ভান্ডার লুট’। ততদিন শুধু একটু অপেক্ষা আর ধৈর্য ধরতে হবে ভক্তকূলকে।
চিত্র ঋণ – চাঁদ কুমার ঘোষ এবং অধিরথ দে
Discussion about this post