চট্টগ্রাম, বাংলাদেশের এ জেলাটির কথা উঠলে চোখের পর্দায় ভেসে উঠবে, পাহাড় আর সমুদ্র বেষ্টিত দৃষ্টিনন্দন এক জনপদ। এখানকার অধিবাসীরা চট্টগ্রামকে ‘বীরচট্টলা’ বলে ডাকতে পছন্দ করেন। এ নামের পেছনে রয়েছে মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যু প্রতিরোধ, ব্রিটিশবিরোধী লড়াই – সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস।
পাহাড়, সমুদ্র আর সংগ্রামের ইতিহাস ছাড়াও চট্টগ্রামের রয়েছে আঞ্চলিক খাবারের স্বকীয় ঐতিহ্য। তেমনই একটি খাবার ‘বেলা বিস্কুট’। চট্টগ্রাম শহরে অবস্থিত গণি বেকারিতে এ বিস্কুটের জন্ম, এবং এটি এই বেকারিকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে আসে। যা এখনও বর্তমান। মুঘল আমলের শেষ এবং ব্রিটিশ আমলের প্রথম দিকের কোনো এক সময় চট্টগ্রামের লাল খাঁ সুবেদার ও তাঁর ছেলে কানু খাঁ মিস্ত্রি শহরের চন্দনপুরা এলাকায় একটি বেকারি স্থাপন করেন। তবে নির্দিষ্ট করে জানা যায় না যে, ঠিক কত সাল থেকে তাঁরা বেলা বিস্কুট তৈরী করতে শুরু করেন। এখানে উল্লেখ্য, মোগল, পর্তুগিজ ও ইংরেজরা ভিন্ন-ভিন্ন সময় চট্টগ্রামে অবস্থান করেছে। কাজেই এ অঞ্চলে বেকারিতে তৈরী খাবারের প্রচলন শুরু হয় তাদের হাত ধরে।
লাল খাঁ সুবেদারের বংশপরম্পরায় ১৮৭৮ সালে বেকারির দায়িত্ব এসে ওঠে তাঁর বংশধর আব্দুল গণি সওদাগরের হাতে। গণি সওদাগর দায়িত্বে আসার আগপর্যন্ত এ বেকারির এতটা নামডাক ছিল না। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর বেকারির অবকাঠামো ও নামে পরিবর্তন আনেন। তার তত্ত্বাবধানে বিস্কুটের গুণগত মান ভালো হওয়ায় দ্রুতই গণি বেকারির নাম ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে এই বেকারির দায়িত্বে আছেন গণি সওদাগরের বংশধর আবদুল্লাহ মোহাম্মদ এহতেশাম। তাঁরা এখনও বেলা বিস্কুট তৈরীর সনাতন পদ্ধতি ধরে রেখেছেন। এর ফলে এ বিস্কুট তৈরী হতে কমপক্ষে দু’দিন সময় লাগে। তৈরী প্রক্রিয়ার প্রথমে ময়দা, চিনি, লবণ, ভোজ্যতেল, ডালডা, গুঁড়ো দুধ জলে মিশিয়ে খামি তৈরি করা হয়। এই খামিতে ইস্টের পরিবর্তে বিশেষ ধরনের মাওয়া দেওয়া হয়। মাওয়ার উপাদান তাঁরা গোপন রেখেছেন সেই শুরু থেকেই। মূলতঃ এই মাওয়া এ বিস্কুটের অনন্য স্বাদের রহস্য। খামিতে মাওয়া মিশিয়ে একদিন রাখার পর তন্দুরে প্রথম এক দফায় এক থেকে দেড় ঘণ্টা সেঁকা হয়। এরপর দ্বিতীয় দফায় আবারও সেঁকে বেলা বিস্কুট তৈরি করা হয়।
যুগের দাবী নিয়ে বৈদ্যুতিক ওভেন এলেও তাঁরা এখনও মাটির তৈরী দুটো তন্দুরে বিস্কুট তৈরী করে থাকেন৷ এ বিস্কুট দেখতে গোল এবং পুরু। চায়ে ভিজিয়ে খাওয়ার জন্য এটি জনপ্রিয় চট্টগ্রামে। মজার ব্যপার হচ্ছে, এই বিস্কুটের ক্রেতাদের একটি বড় অংশ বংশপরম্পরায় এটি কিনে আসছেন! ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া কিংবা আমেরিকা, যেখানেই চট্টগ্রাম শহরের মানুষ আছেন সেখানেই পৌঁছে যায় গণি বেকারির বেলা বিস্কুট।
Discussion about this post