‘বিষাদসিন্ধু’র রচয়িতা মীর মোশাররফ হোসেন, বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ অক্ষয়কুমার দত্ত, দীনেন্দ্রনাথ রায়, সাহত্যিক জলধর সেন ছিলেন এই বাঙালির শিষ্য। তিনি হরিনাথ মজুমদার। তিনি নিজে ছিলেন বাউল সম্রাট লালন ফকিরের ভাবশিষ্য। তাঁর গোটা জীবনদর্শনের গুরু ছিলেন লালন ফকির। হরিনাথের বহু পরিচয়, বহু প্রতিভার মধ্যেও সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন সমাজসংস্কারক এবং প্রতিবাদী। রবীন্দ্রনাথের পরিবারের জমিদারির পন্থার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন এই হরিনাথ মজুমদারই।
কবি-সাহিত্যিক ও ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ পুরোনো জনপদ ছিল কুমারখালি। কুষ্টিয়ার পরিচয় দিতে গেলে বলা হত কুমারখালির কুষ্টিয়া। এই কুমারখালিতেই ১৮৩৩ সালের ২২ জুলাই হরিনাথ মজুমদার জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অল্পবয়সে হয়েছিলেন অনাথ। আর্থিক অনটনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা বেশিদূর করতে পারেননি। কিন্তু তারজন্য তিনি পড়াশোনা কে বাদ দেননি কখনও। ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে শিবনাথ শাস্ত্রী, হরিনাথ মজুমদারের ‘বিজয় বসন্ত’ ও টেকচাঁদ ঠাকুরের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থ দুটিকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস বলে স্বীকার করেছিলেন।
হরিনাথ একাধারে ছিলেন কবি, গীতিকার, লেখক, সম্পাদক, সাহিত্যিক, প্রকাশক, সমাজসংস্কারক, সংগঠক এবং বেশ কয়েকটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। এর সঙ্গেই তিনি ছিলেন সাংবাদিক। ১৮৫০ সালে তিনি নীলকুঠির হেড অফিসে চাকরি নেন। কিন্তু বেশি দিন টিকে থাকতে পারেননি। কারণ, প্রজাদের ওপর কুঠিয়ালদের অত্যাচার ও শোষণ তিনি বরদাস্ত করতে পারেননি। ফলে শোষণের এই কাঠামো ভাঙার চিন্তা থেকেই হরিনাথ মজুমদার ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকা প্রকাশ করে তাতে লেখালিখি করতে থাকেন। এই থেকেই শুরু তাঁর সাংবাদিকতা।
কলকাতার বাইরে সুদূর কুমারখালির মত মফঃস্বলে সাংবাদিকতা, শিক্ষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার পরিবেশ তৈরি করেছিলেন তাঁর পত্রিকার মাধ্যমে। তুলেছিলেন ঠাকুরবাড়ির জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সুর। তবে বড় কান্ডটি হয়েছিল, যখন স্বয়ং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর হরিনাথকে শায়েস্তা করবার জন্য পাঠিয়েছিলেন লেঠেলদের দল। শোনা যায়, সেই সময় লালন ফকিরের শিষ্যরা একতারা ফেলে অস্ত্র নিয়ে হরিনাথকে বাঁচিয়েছিল। ঠাকুরবাড়ির কোনো জমিদারই রবীন্দ্রনাথের মত ‘আশমানদারি’ করেননি। রবীন্দ্রনাথ এসেই বদলে গিয়েছিল সব। রবীন্দ্রনাথ হরিনাথ মজুমদারের লেখাপত্রের খবরও রাখতেন। হরিনাথ মজুমদারের মৃত্যু হয়েছিল ১৮৯৬ সালে।
Discussion about this post