হাতিরপুল, হাতিরঝিল, গজমহল, হাতিরহাট, মাহুতটুলি, এলিফ্যান্ট রোড। ভাবছেন এসব আবার কী? এগুলি বাংলাদেশের ঢাকা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলের নাম। নামগুলি হাতির সঙ্গে সংযুক্ত হলেও, এসব জায়গায় গেলে কিন্তু হাতির দেখা আজ পাবেন না। এ যেন অনেকটা সেই ‘শিং নেই তবু নাম তার সিংহ’ বা ‘শিয়ালদহে শিয়াল নেই কেন’র মত ব্যাপার। অথচ নামগুলি যখন তৈরি হয়েছিল, তখন কিন্তু এসব জায়গায় হাতির দেখা পাওয়া যেত। দেখেছিলেন হেবার সাহেব। প্রায় দুশো বছর আগে ১৮২৪ সালে হেবার সাহেব কলকাতা থেকে নৌকা করে ঢাকায় পৌঁছেছিলেন। সেই সময়ের ঢাকা শহরে হাতির কদর দেখে তিনি অবাক হয়ে যান।
বাংলায় হাতির কদর রণপটু, পরিশ্রমী হিসেবে সেই আদিকাল থেকে। দিল্লি দরবারেও এই কদর ছিল। ভারতের ইতিহাসে যুদ্ধক্ষেত্রে হাতি ব্যবহারের সূচনা করেন রাজপুতরা। সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে যুদ্ধে হাতির ব্যবহার শুরু করেন বাবর। ঢাকাতেও হাতির পালের আগমন ঘটে মুঘল আমলেই। সম্রাট আকবরের ‘হলকা’ নামের এক হাতিবাহিনী ছিল। জাহাঙ্গীরের সময় থেকে বুনো হাতি ধরে পোষ মানানোর ব্যবস্থা শুরু হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বুনো হাতি ঢাকায় এনে পোষ মানানো হত। পরবর্তীকালে ইংরেজ সরকারকেও হাতি ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে। ১৮৬০ সালে পাহাড়ি উপজাতি দমনে হাতি ব্যবহার হত। রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের যোগাযোগের কাজে হাতি ব্যবহার হত৷ ১৮৮১ সালেও হাতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অসংখ্য কর্মচারীরা ছিলেন। ঢাকার অভিজাত নাগরিকরাও শখে হাতি কিনতেন। ঈদ, মহরম বা জন্মাষ্টমীর মিছিলে সুসজ্জিত হাতির পাল ছিল অন্যতম আকর্ষণ।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ঢাকায় হাতি রাখা হত পিলখানা এলাকায়। জায়গার নাম এখনও এক। পিলখানার হাতিদের স্নান করানো হত একটি ঝিলে। লোকমুখে তার নাম হয় ‘হাতিরঝিল’। প্রতি সন্ধ্যায় হাতির দল ফিরত পিলখানায়। এই অঞ্চলে হাতির পালের যাতায়াতের জন্য তৈরি হয়েছিল নতুন পথ। এর নাম আজ ‘এলিফ্যান্ট রোড’। ঐ রাস্তায় রেললাইনের উপরে হাতির যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছিল সাঁকো, তার নাম ‘হাতিরপুল’। হাতির নিয়ন্ত্রক মাহুতদের ঘর ছিল ‘মাহুতটুলি’ এলাকায়। এ জায়গাগুলি ছাড়াও হাতিরহাট, সাত মসজিদ ঝিল, কুড়িপাড়াঝিল প্রভৃতি স্থানগুলি জড়িয়ে আছে হাতির স্মৃতির সঙ্গে।
পরে হাতির কার্যালয় মায়ানমারে প্রতিস্থাপিত হয়। ঢাকায় হাতির সংখ্যা কমে। যানবাহনের প্রচলনের ফলে হাতির ব্যবহার কমে যায়। পাশাপাশি কারখানার আবিষ্কার, নগরায়নের জন্য গাছপালাও কমতে থাকে। হাতির সংখ্যা নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখোমুখি হয়। বর্তমানে বেড়েছে চোরাশিকারিদের হাতি হত্যাও। বিপন্ন হাতির পালক মাহুত সম্প্রদায়। হাতি নিয়ে ঢাকা শহরের ইতিহাস আজ বেঁচে আছে কয়েকটি জায়গার নামের মধ্যেই।
তথ্য ঋণ – Stay Curious SIS
Discussion about this post