বাংলা চলচ্চিত্র জগতে বিমল রায়ের নাম আজকাল খুব বেশি শোনা যায় না। অথচ সত্যজিৎ রায়েরও আগে বিশ্বের চলচ্চিত্র দরবারে বাংলা চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক করে তুলেছিলেন তিনিই। আজকের যে চলচ্চিত্র নির্মাতারা ‘কান’ জয়ের স্বপ্ন দেখছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই সেখানে সত্যজিৎ রায়ের সাফল্য অর্জনের কথা জানেন। কান চলচ্চিত্র উৎসবে উপমহাদেশীয় অর্জনের কথা বললে পথের পাঁচালির মানবিক দলিল (১৯৫৬) হিসেবে পুরস্কার প্রাপ্তির কথাই শোনা যায় বেশি। কিন্তু বিমল রায় কান জয় করেছিলেন ‘পথের পাঁচালি’র মতো ছবিরও বছর দুই আগে। ১৯৫৪ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসব জয় করেছিল বিমল রায়ের ছবি ‘দো বিঘা জমিন’। ছবিটি সেরা আন্তর্জাতিক ছবির পুরস্কার পেয়েছিল। বিমল রায় একাধারে ছিলেন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালি চিত্র পরিচালক এবং প্রযোজকও। ১৯০৯ সালের ১২ জুলাই বাংলাদেশের অধুনা ঢাকার সুত্রাপুরের এক জমিদার বাড়িতে জন্ম হয় তাঁর। ঢাকার জগন্নাথ কলেজে পড়াকালীন তাঁর বাবা গেলে মা ও ভাইদের নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন তিনি।
ক্যামেরার প্রতি অসম্ভব ঝোঁক ছিল তাঁর সেই ছোটবেলা থেকেই। শুরুটা হয়েছিল নীতিন বোসের হাত ধরে। তাঁর ক্যামেরার সহকারী হিসেবে নিউ থিয়েটার্সে সুযোগ পান তিনি। এরপর সেই সুবাদেই প্রমথেশ বড়ুয়ার ছায়াছবির প্রচারের জন্য ছবি তোলার কাজ পান। ১৯৩৫ সালে প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘দেবদাস’-এর সিনেমাটোগ্রাফার ও সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। যদিও তার পরের দশকেই ছবিটি তিনি নিজের পরিচালনায় নতুনভাবে বানান। তিরিশের দশকে তিনি ব্রিটিশ সরকারের হয়ে দুটি তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন – ‘How Kerosene Tins Are Made’, ‘I Grand Trunk Road’। ১৯৪৪ সালে বিমল রায়ের পরিচালনায় নিউ থিয়েটার্সের বাংলা ছবি ‘উদয়ের পথে’ মুক্তি পায় । শ্রেণী সংগ্রাম ভিত্তিক সেই বলিষ্ঠ ছবিটি ওই সময়ের চলচ্চিত্র সমালোচকদের কাছ থেকে ভূয়সী প্রশংসা লাভ করে। পরের বছরই ছবিটির হিন্দি রূপ ‘হামরাহী’ নির্মাণ করেন তিনি।
চল্লিশের দশকের শেষে দেশভাগের পর নিউ থিয়েটার্সের প্রতিপত্তি কমতে থাকে। এক সময় সেটি বন্ধই হয়ে যায়। সেই সময় অশোক কুমারের উদ্যোগে মুম্বইয়ে হিমাংশু রাই-দেবিকা রানী প্রতিষ্ঠিত ‘বম্বে টকিজ’-এ যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ পান বিমল রায়। বম্বে টকিজ থেকে তাঁর ছবি ‘মা’ যেটি মুক্তি পায় ১৯৫২ সালে। এছাড়াও পরের বছরেই শরৎচন্দ্রের ‘পরিণীতা’ উপন্যাস অবলম্বনে রচিত চলচ্চিত্রের পরিচালক ছিলেন বিমল রায়। এরপর তিনি নিজেই একটি ছবির কোম্পানি খোলেন। তার সেই প্রোডাকশনেরই প্রথম ছবি ছিল ‘দো বিঘা জমিন’।
বিমল রায় এক সঙ্গে দুটি ছবির কাজ শুরু করেন। একটি হল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পরিণীতা’ ও অন্যটি সলিল চৌধুরীর লেখা গল্প ‘রিকশাওয়ালা’ অবলম্বনে ‘দো বিঘা জমিন’। পরিণীতা ছিল অপেক্ষাকৃত বড় বাজেটের ছবি। এর পাশে ‘দো বিঘা জমিন’ কম পয়সায় বানানো হয়েছিল। কিন্তু দর্শক মহলে ‘পরিণীতা’ সেভাবে সমাদর পেল না। অন্যদিকে ‘দো বিঘা জমিন’ ভারতীয় সিনেমায় এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল। ইটালির নিও-রিয়্যালিস্টিক ছাদে তোলা এই ছবি বক্স অফিসে খুব একটা আলোড়ন না ফেললেও দেশি ও বিদেশি চিত্র সমালোচকদের অকুণ্ঠ প্রশংসা পায়। লীলা চিটনিস, ভারত ভূষণ ও শ্যামা অভিনীত এ ছবির গল্প ছিল নিতান্তই গতে বাঁধা একটি মেলোড্রামা। কিন্তু বিমল রায়ের হাতের ছোঁয়ায় ছবিটি অন্য জন্ম লাভ করে। তাঁর হাত ধরেই বাণিজ্যিক ও সমান্তরাল সিনেমার এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধন সূচনা করেছিল ভারতীয় সিনেমা। এরপর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গল্প নিয়ে বিমল রায় হিন্দিতে আরও দুটি ছবি করেন- ‘বিরাজ বউ’ (১৯৫৪) ও ‘দেবদাস’ (১৯৫৫)। এর মাঝে ১৯৫৪ সালে ‘বাপ-বেটি’ ও ‘নৌকরি’ নামে আরও দুটি ছবি পরিচালনা করেন তিনি। এই ছবিগুলিতে বিমল রায়ের শিল্পীসত্ত্বার পূর্ণ পরিচয় থাকলেও বাণিজ্যিকভাবে খুব একটা সফল হয়নি। ১৯৫৮ সালে তিনি তৈরি করেন দুটি ছবি- ‘মধুমতী’ ও ‘ইয়েহুদি’। বাণিজ্যিকভাবে দুটি ছবিই সুপারহিট হয়। মস্কোয় ১৯৫৯ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের বিমল রায় অন্যতম জুরি ছিলেন। তিনি কিছুকাল ফিল্ম গিল্ড অফ ইন্ডিয়ার সহকারী সভাপতি এবং ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির সভাপতি হয়েছিলেন।
শোনা যায়, মুম্বাইয়ে তার সাফল্যে কিছুটা ঈর্ষান্বিত হয়ে পূর্বজন্ম নিয়ে একটি অতি সাধারণ গল্প তাকে দেন ঋত্বিক ঘটক। কিন্তু ওই সাধারণ গল্পই মধুমতী গল্পে অসাধারণ হয়ে ওঠে বিমল রায়ের কুশলী হাতে। এর সুরকার ছিলেন সলিল চৌধুরী। তখন ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হতো ছবির গুণগত মান বিচার করে। এই চলচ্চিত্রটি মোট ৯টি ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পকেটে পোরে। ১৯৫৯ সালে বিমল রায় আরেকবার তার নব্য বাস্তববাদী সত্ত্বার পরিচয় রাখলেন ‘সুজাতা’য়। এই সিনেমার মাধ্যমে আমাদের সমাজে প্রচলিত ‘জাতের নামে বজ্জাতি’র কুরূপ উন্মোচন করা এক সহানুভূতিশীল প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছিল। সংবেদনশীল মন নিয়ে বিমল রায়ের সুসংযত পরিচালনা ও নায়িকা নূতনের অপূর্ব অভিনয় সুজাতা ছবির এক মস্ত সম্পদ। বিমলের শিল্পী সত্তার এক নতুন দিকের পরিচয় পাওয়া যায় ‘পরখ’ (১৯৬০)-এ। অর্থলোভ নিয়ে এক অসাধারণ স্যাটায়ার তৈরি করেছিলেন তিনি। আজও তা ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক।
বিমল রায় পরিচালিত শেষ কাহিনী চিত্র ‘বন্দিনী’ (১৯৬৩)। নূতনের অভিনয় প্রতিভা তিনি আবার কাজে লাগালেন জরাসন্ধ-এর লৌহ কপাট থেকে নেওয়া গল্প ‘বন্দিনী’ ছবিতে। জরাসন্ধের গল্প, নবেন্দু ঘোষের চিত্রনাট্য, নূতনের অসামান্য অভিনয় ও শচীন দেববর্মণ এর সঙ্গীত। সব মিলিয়ে ‘বন্দিনী’কে অনেক চিত্র সমালোচকই বিমল রায়ের শ্রেষ্ঠ ছবি বলে থাকেন। বন্দিনীতেই তাঁর মধ্যে সব থেকে বেশি করে আবিষ্কার করা যায় কুইন্টেসেনশিয়াল নব্য বাস্তববাদী পরিচালক ভিত্তোরিও দে সিকা-র ছায়া। এরপর বেশ কিছুদিন ফুসফুসের ক্যানসারে ভোগার পর ১৯৬৬ সালের ৮ জানুয়ারি মাত্র ৫৬ বছর বয়সে বিমল রায়ের মৃত্যু হয়।
Discussion about this post