রোজা এবং ইফতার একে অপরের পরিপূরক। রোজাদাররা পরিস্থিতি পরিবেশ অনুযায়ী, দিন শেষে নানা পন্থায় রোজা ভেঙে থাকেন। পুরনো কলকাতায় তেমন জনবসতি ছিল না। তখনও পলাশীর যুদ্ধ হতে বছর বিশ বাকি। বাংলার নবাব তখন সুজাউদ্দিন মহম্মদ খান। আলিবর্দি খান তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি। ভাগীরথীর পূর্ব পাড়ে এখন যে জায়গাটিকে বাগবাজার বলে, তখন সেখানে ছিল সুতানুটি গ্রাম। জব চার্নক ওইখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য কুঠির পত্তন করেছিলেন ১৬৯০ সালে। ১৭৩৭ সালে সুতানুটি গ্রামের আশপাশে ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জনাকয়েক কর্তার প্রাসাদ। কয়েকজন ধনী বাঙালিও সেখানে নির্মাণ করেছিলেন পাকা বাড়ি এবং দেবালয়। আর ছিল গুটিকতক খোলার বস্তি। সব মিলিয়ে কলকাতার বাসিন্দা তিন হাজারের বেশি ছিল না।
মোটামুটি কলকাতার সঙ্গে মুর্শিদাবাদের সেই সময় ভালো যোগাযোগ ছিল। পুরানো কলকাতা সহ মুর্শিদাবাদে তখন এককালে নবাবি আমলে রমজান মাসে অঞ্চলের চেহারাটাই যেন বদলে যেত। দরিদ্র আম-আদমিও দু’বেলা পেট পুরে শাহী খাবারের স্বাদ গ্রহণ করতেন। বছরভর অবশ্য তা সম্ভব ছিল না। কিন্তু রমজান উদারতার মাস, দানের লগ্ন। খোলা মনে নবাবরাও তাই দান করতেন হাত খুলে। নবাবদের বক্তব্য ছিল, সারা বছর দু’বেলা ভাল করে খেতে না পাওয়া মানুষগুলো রমজানের একটা মাস অন্তত শাহী খাবারের স্বাদ গ্রহণ করুক। নবাবি আমলের সন্ধ্যা নামলেই ভারতের রাজধানী মুর্শিদাবাদ ভরে উঠত শাহী খাবারের হরেক পদের সুবাসে। প্রতিটি বাড়ি এবং মসজিদে প্রতিদিন আয়োজন করা হত ইফতারের। সে আমলে সকল রোজাদারদের খাওয়াতে খোলা হত লঙ্গরখানা। সেখান থেকেই পরিবেশন করা হত শাহী খাবার। একই রকম ভাবে উৎসবের ছোঁয়ায় সামান্য হলেও সিক্ত হত পুরনো কলকাতা।
ইতিহাস সাক্ষী দেয়, নবাব মীরজাফরের পত্নী মুন্নি বেগম ছিলেন খুব দয়ালু। তিনি প্রচুর দান-ধ্যানও করতেন। তাঁর নির্মিত চক মসজিদে রোজাদারদের ইফতার করাতেন। পরে নবাব হাসান আলি মির্জার আমলে নতুন এক প্রথা শুরু হল। নবাবের পুত্র মুর্শিদাবাদের দ্বিতীয় নবাব বাহাদুর ওয়াসিফ আলি মির্জা ইংল্যান্ডে পড়ার সময়ে রোজা রাখতে পারতেন না। পরিবর্তে রমজান মাসে প্রতিদিন ৬০ জন রোজাদারকে দুই বেলা খাওয়ানো হত। পরবর্তী সময় ওয়াসিফ আলি মির্জা দেশে ফিরে রোজা রাখলেও তিনি তাঁর পিতার প্রচলিত নিয়ম বজায় রাখেন। পুরনো কলকাতা সহ মুর্শিদাবাদ মেতে উঠত ইফতারের আনন্দে। কী কী থাকত সেই নবাবি ইফতারে? সারা বাংলা গ্রীষ্মপ্রধান হওয়াতে শরবত দিয়েই শুরু হত ইফতার পর্ব। শরবত তৈরিতে প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হত দুধ। এর সঙ্গে থাকত নানান রসালো ফলের নির্যাস, বিভিন্ন প্রকার বাদাম, কিসমিস, পেস্তা, জাফরান। এছাড়াও তোকমার শরবত, বেলের শরবত, বেদানার শরবত, লেবু ও তেঁতুলের শরবতও তখন থেকেই পুরনো কলকাতার বুকে জনপ্রিয় ছিল। শরবতের পাশাপাশি থাকত ঠান্ডা ও সুমিষ্ট ফালুদা এবং ফিরনি সহ আরও নানা ধরনের মিষ্টি। কখনও সুস্বাদু ভাজাভুজি, তো কখনও রুটি-মাংস। কথিত আছে, নবাবি আমলে রাতের নমাজের পর প্রতিদিনই রোজাদারদের বিরিয়ানি খাওয়ানো হত।
Discussion about this post