পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি বাঙালি ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। পৌষ মাসের শেষ দিন এটি। দিনটির সাথে জড়িয়ে আছে প্রাচীন বহু রীতি ও সংস্কৃতি। সুদূর বাংলাদেশ কিংবা কলকাতা যেন মিলে মিশে এক হয়ে যায় এই দিনটিতে। শুধু বাঙালিরাই নন, আমাদের দেশের নানা প্রান্তে এই দিনটিকে নানা ভাবে বিশেষ বিশেষ উৎসবের সঙ্গে পালন করা হয়। দিনটিতে রকমারি পিঠে-পুলি বানিয়ে খাওয়া হয়। এই দিনেই হয়ে থাকে বাস্তুদেবের পুজা।
এই পুজো খুব শ্রদ্ধার সাথে নিয়ম মেনে পালন করা হয়। বাড়ির উঠোনে কাপলা গাছের ডাল দিয়ে এই পুজো হয়ে থাকে। এই পুজোর প্রধান অঙ্গ চরুপাক। মাটির উনুনে মিষ্টি ছাড়া অল্প দুধের পায়েস চরুপাক নামে পরিচিত। সাধারণত নতুন মাটির হাঁড়ি বা পেতলের মালসায় সোয়া সের দুধ দিয়ে চরু করা হয়। পুরোহিত প্রথমে একটা কলাপাতায় সিঁদুর ফোঁটা ও ধান দূর্বা সহ কিছুটা চরু বেড়ে দেন। এরপর পৌরাণিক পদ্ধতি মেনে এই পুজো সম্পন্ন হয়।
বাস্তুদেবের পূজার পর বেদির চার কোনে শঙ্খপাল, বঙ্ক পাল, ক্ষেত্র পাল ও নাগ পাল এর পুজো হয়। এরপর চরু নিবেদনের শেষে কলা পাতাটি মুড়ে ঘরের পাশে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়। নতুন মাটির কল্কের সাহায্যে বাড়ির উঠানে, ঘরের দরজায় চালগুড়ো দিয়ে বেজোর সংখ্যক গোল গোল চিহ্ন দেওয়া হয়। এই বৃত্তগুলোর ভেতরে সিঁদুর, ধান দূর্বা ও নতুন পাটালি গুড়, তিলের খাজা, তিলা কদমা ইত্যাদি দেওয়া হয়। একে বলে বাস্তুকে পিঠে খাওয়ানো। অনেক পরিবারে বেদির দু’পাশে মাটির কুমির ও কচ্ছপ গড়ে দেওয়ার রীতি ও দেখা যায়।
উৎসবের রেশ থেকে যায় পরের দিন অর্থাৎ পয়লা মাঘ পর্যন্ত। অন্যতম আকর্ষণ থাকে এই দিনটিতে। এইদিন বাড়িতে জোড়া ইলিশ মাছ আনা হয়। মাছের গায়ে তেল, হলুদ বাটা, মাথায় সিঁদুর পড়িয়ে সারা বাড়ি প্রদক্ষিণ করা হয়, বলা হয় ইলিশ মাছের বিয়ে হচ্ছে। এরপর একটা মাছ জোড়ে অর্থাৎ গাদা- পেটি আলাদা করে কাটা হয়, অন্যটি একছায়া অর্থাৎ গাদাপেটি আলাদা না করে কাটা হয়। তারপর তা খুব পাতলা করে রান্না করা হয়।
মকর সংক্রান্তি আরো একটি কারনে গুরুত্বপূর্ণ। মকর সংক্রান্তির এই মহাতিথিতেই মহাভারতে পিতামহ ভীষ্ম শরশয্যায় ইচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করেছিলেন। আবার অন্য মত অনুযায়ী, এই দিনই দেবতাদের সঙ্গে অসুরদের যুদ্ধ শেষ হয়েছিল। ভগবান বিষ্ণু অসুরদের বধ করেছিলেন। তাই মকর সংক্রান্তির দিনই সমস্ত অশুভ শক্তির বিনাস হয়ে শুভ শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে আজও মানা হয়ে থাকে। আবার অন্য মতে, সূর্য এ দিন নিজের ছেলে মকর রাশির অধিপতি শনির বাড়ি এক মাসের জন্য ঘুরতে গিয়েছিলেন। তাই এই দিনটিকে বাবা-ছেলের সম্পর্কের একটি বিশেষ দিনও বলা হয়।
তথ্য ঋণ – অরুণিমা মুখার্জী
Discussion about this post