২০০৩ সালের শুরুর দিক থেকে মেক্সিকো শহরে পরপর খুন হতে থাকলেন কিছু বৃদ্ধা নারী। ঘরের কোণায় পড়ে থাকা দড়ি অথবা টেলিফোনের তার, সেগুলিই গলায় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করা হত তাদের। ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল, এই তিন বছরে একই পদ্ধতিতে প্রায় ১১ জন বৃদ্ধ নারী খুন হন। তবে খুনগুলি কে করেছিল তা জানলে তাজ্জব হয়ে যেতে হয় বৈকি! এই হত্যাকান্ডের নেপথ্যে ছিলেন মেক্সিকোরই এক মহিলা রেসলার, জুয়ানা বারাজা। গোটা রেসলিং রিং যাকে চিনত ‘দ্য লেডি অফ সাইলেন্স’ নামে। অবশ্য মেক্সিকোর পুলিশ বাহিনীর কাছে তাঁর নাম ছিল ভিন্ন। সেখানে তিনি পরিচিত মাতাভিয়েজিতাস বা ‘লিটল ওল্ড লেডি কিলার’ নামে। খাঁটি বাংলায় যাকে বলা যেতে পারে ‘বৃদ্ধ নারীদের খুনি’। একদিকে রেসলিং অন্যদিকে একের পর এক খুন, সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই সত্ত্বার জুয়ানাকে খুঁজে বের করতে অবশ্য ভালোই বেগ পেয়েছিল মেক্সিকোর পুলিশ বিভাগ আজ সেই কাহিনীই শোনানো যাক।
মেক্সিকো দেশে প্রো-রেসলিং বা পেশাদার রেসলিং বেশ জনপ্রিয়। তবে রেসলিং বলতে আমরা যা বুঝি, মেক্সিকোতে তা কিছুটা আলাদাই ছিল। বরং অনেক বেশি আড়ম্বর আর উত্তেজনাপূর্ণ রেসলিং হয় সেই দেশে। রঙিন মুখোশ পরে নানা অঙ্গভঙ্গি করে প্রতিদ্বন্দ্বীর ওপরে মঞ্চের দড়ি ছিঁড়েই যেন ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় রেসলার। তবে জুয়ানার জন্য এই রেসলিং রিংয়ের দুনিয়াটা ছিল একটু অন্যরকম। পেশাগত রেসলিং ছাড়াও দিনের বেলায় পপকর্ন বিক্রি করতেন তিনি। আর খেলার দিন মেক্সিকোর বিখ্যাত কোনও রেসলিংয়ের রণক্ষেত্রে যুদ্ধ সাজে দেখা মিলত তাঁর। একজন লড়াকু মহিলা রেসলার হিসাবে সব্বাই তাঁকে চিনত। শুধু তাঁর অন্ধকার জীবনের দিকটাই জানা ছিল না কারুর। খুনের ক্ষেত্রে ভিক্টিম বেছে নিতে কোনও নির্দিষ্ট প্যাটার্ন না মেনে বরং একটু ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছিলেন জুয়ানা। প্রথমেই বিভিন্ন সরকারি সংস্থা থেকে নারীদের তালিকা সংগ্রহ করতেন। এর পরের ধাপ ছিল তার মধ্যে থেকে সবচেয়ে বয়স্ক নারীদের খুঁজে বের করা। এরপর সেইসব সরকারি সংস্থারই কাগজ চুরি বা নকল করে নিজে নার্স সেজে তাদের ঘরে ঢুকতেন তিনি। চুপচাপ নিজের কাজ সেরে বেরিয়ে আসতেন। ভিক্টিমের বাড়ি থেকে বেরোবার সময় তার কোনও না কোনও স্মৃতিচিহ্ন সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন তিনি।
বলা বাহুল্য, এই অদ্ভুত পদ্ধতির সঙ্গে মেক্সিকোর পুলিশ ডিপার্টমেন্ট মোটেই পরিচিত ছিল না। এমনকি অপরাধবিজ্ঞানীরাও খুনীকে ‘কনফিউজড সেক্সুয়াল আইডেন্টিটি’তে ভোগা এক পুরুষ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। ফলতঃ জুয়ানার ওপর সন্দেহের আঁচটুকুও এসে পড়েনি। এদিকে হন্যে হয়ে খুনিকে খুঁজে বেড়াতে লাগল পুলিশ। পুলিশকে বোকা বানিয়ে এভাবেই জুয়ানার দিন বেশ কেটে যাচ্ছিল। হঠাৎই ২০০৬ সালে এসে ঘটে ছন্দপতন! ৮২ বছর বয়সী এক বৃদ্ধাকে শ্বাসরোধ করে খুন করে বেরোনোর সময় জুয়ানার সঙ্গে দেখা হয় ওই বৃদ্ধার পেয়িং গেস্টের। বাড়িতে ঢুকেই তার বাড়িওয়ালির মৃতদেহ চোখে পড়তেই পুলিশকে ফোন করে সে। এক প্রত্যক্ষদর্শীর সাহায্যে এলাকা ছেড়ে পালানোর আগেই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জুয়ানা। পরে জিজ্ঞাসাবাদের সময় শুধুমাত্র ৮২ বছরের বৃদ্ধাটিকেই খুন করার কথাই স্বীকার করেন তিনি। এমনকি বয়স্ক নারীদের প্রতি তাঁর এক চরম বিতৃষ্ণা রয়েছে বলেও জানান। নিজের মায়ের প্রতি বিরূপ মানসিকতাই তাঁর এই ঘৃণার জন্ম দেয়। মা ছিল নেশাগ্রস্ত। ফলে দেখাশোনার দায়প্রাপ্ত সৎ বাবার শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয় জুয়ানা। আর তার রাগটা এসে পড়ে মায়ের ওপরেই। মাত্র ১২ বছর বয়সেই তাই পেশা হিসেবে রেসলিংয়ের মতো লড়াকু খেলাকে বেছে নিয়েছিল সে। আর নেশা হিসেবে বেছে নেন সকলের অগোচরে বৃদ্ধাদের খুন করা।
ধরা পড়ার পর জুয়ানা দাবী করেন, এই সমস্ত খুনগুলির জন্য সে মোটেই একা দায়ী নয়। গণমাধ্যমের সামনে তিনি জানান, “কর্তৃপক্ষের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই বলছি, আমি একা এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত না। আমার মতো আরও অনেকেই এমন অন্যায় জুলুম আর খুনের সাথে যুক্ত। পুলিশ কেন তাদেরকেও গ্রেপ্তার করছে না?” তবে একটি খুনের কথা স্বীকার করলেও, জুয়ানার বিরুদ্ধে থাকা তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তাকে বহু বছরের কারাদণ্ডের নিদান দেওয়া হয়। যা শুনে জুয়ানার বক্তব্য, “আমি জানি, আমি যা করেছি তা নিঃসন্দেহে একটি অপরাধ। যা করেছি, তার জন্য শাস্তি তো পেতেই হবে। কিন্তু অন্যের অপরাধের সাজাও কেন আমাকে দেয়া হচ্ছে, বুঝলাম না।” তবে মেক্সিকোর প্রধান প্রসিকিউটর বার্নান্দো বাটিজ এই সিরিয়াল কিলিংগুলির সঙ্গে জুয়ানার যুক্ত থাকার কথা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেন। এমনকি জুয়ানার সঙ্গে নিষিদ্ধ মাদক পাচারকারী সংস্থা ‘সান্তা মুয়ের্তে’-রও যোগাযোগ ছিল বলেই মনে করছে মেক্সিকোর পুলিশ।
Discussion about this post