১৯৬৯, সালটা চিরকাল সঙ্গীত আর সংস্কৃতি জগতের ইতিহাসে অন্য কোনো রঙের কালিতে লেখা থেকে যাবে, কারণ সেই মহাসম্মেলন, সেই চার জন অপটু তরুণ উদ্যোগপতির নেওয়া একটা পাগলাটে পদক্ষেপ যার নাম হয়েছিলো উডস্টক ফেস্টিভ্যাল। একটা ডেয়ারী ফার্মের মাঠে শান্তি আর ভালোবাসার বার্তা দিতে এসেছিলেন একঝাঁক পরিচিত সাংস্কৃতিক মুখ। মহাসমারোহে পালিত হয়েছিলো কাউন্টার কালচারের পীঠস্থান উডস্টক’এর উদযাপন, যার গল্পগাথা আজও কনসার্ট সংস্কৃতির গরিমা।
ব্যাপারটা হয়েছিলোও বেশ আনকোরা। জোয়েল রোজেনম্যান, জন রবার্টস, আর্টি কর্নফেল্ড এবং মাইক ল্যাং; এই চারজন মিলে করতে চেয়েছিলেন নিজেদের খোলা নতুন স্টুডিওর খানিক বিজ্ঞাপন, আর সে কারণেই টুকটাক গানবাজনার ব্যবস্থার আয়োজন। তরুণ তুর্কিদের কাছে অভিজ্ঞতার ভান্ডার ছিলো না ঠিকই কিন্তু উদ্যম ছিলো বুকভরা, তাই তাদের ‘সামান্য প্রমোশনাল ইভেন্ট’ গিয়ে দাঁড়ায় জিমি হেন্দ্রিক্স, দ্যা হু, জ্যানিস জপলিন থেকে দ্যা জেফারসন এয়ারপ্লেন অবধি লাইনআপে। এই কনসার্ট ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ভিড়ে থাকা এক আমেরিকার বুকে নেমে আসছে যেখানে তারুণ্য চাইছে একঝলক খোলা হওয়া, একটা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক একাত্মতাবোধের মেহফিল। রক অ্যান্ড রোল কালচারের সুবর্ণ যুগ এবং হিপি কালচারের লাগামছাড়া যৌবনের মিশেলে উডস্টক তৈরী করেছিল এক অভূতপূর্ব উন্মাদনা যার তুলনা একমাত্র সে নিজেই হতে পারে। সামান্য কিছু টিকিট বিক্রি হলেও, পরে অনুষ্ঠানে এসে উপস্থিত হয় চার লক্ষ মানুষ, তিনদিন ধরে চলা এই অবিস্মরণীয় উৎসব পরবর্তী কালে rolling stones এর greatest ever 50 concert এর লিস্টে ১৯ নম্বরে থেকে যায় পাকাপাকিভাবে, ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়ে যায়।
লিপিবদ্ধ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি মানব ইতিহাসে অবিরল এবং তার হাত ধরে ঠিক এবং ভুল উভয় রাস্তাতেই কিন্তু তুলনা টানার চেষ্টা হয়েছে বারবারই, তার মধ্যে ‘৯৪ সালের উডস্টক ভালো ভাবে উতরেও গেছিলো, কিন্তু এরপরে ‘৯৯ সালের উডস্টক 30 নিয়ে আসে মহা বিপর্যয়। কনসার্ট ইতিহাসের অন্যতম কালো অধ্যায় হিসেবে সেটাও থেকে যাবে চিরকালই, তাই বোধ করি বিদগ্ধরা একটিই লেবু বারংবার কচলাতে বারণ করেন। তৃতীয় এবং এযাবৎ কালের শেষ তম উডস্টক’এর বিরুদ্ধে ওঠেনি এহেন অভিযোগ মেলা ভার। প্রয়োজনীয় জল-খাবার-ফাস্ট এইড সমস্ত কিছুর অপ্রতুল বন্দোবস্ত থেকে শুরু করে ডিহাইড্রেশন, পদদলিত হয়ে মৃত্যু এমনকি যৌন হয়রানি অবধি সকল কিছুরই রায়ট নামিয়ে এনেছিলো ‘৯৯ সালের উডস্টক 30।
এসবই ছিলো ইতিহাসের পাতায়, এই মাস দুই আগে অবধিও। কিন্তু তারপর শোনা গেল আরেক অন্যরকম গুঞ্জন পশ্চিমবাংলার সংস্কৃতি জগতে। “আমাদের উডস্টক” আসছে! এই উডস্টক দক্ষিণ কলকাতার ঝকঝকে শপিং মলের পাশের মাঠের উৎসব, এই উৎসবেরও দাবী দাওয়া গুলো একরকম, যুদ্ধ নয় এবার মহামারী সামলে ওঠা পৃথিবীর এক প্রজন্মের দরকার হয়ে উঠেছিল একটা রকিং ঝাঁকুনি, তাই সময়ের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এই ৬ ব্যান্ডের সঙ্গীত মহামেলার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে প্রশ্ন তোলা নিতান্তই মূর্খামি। কিন্তু হায়রে বাঙালির উডস্টক, অনুষ্ঠান শুরু ৩৬ ঘণ্টা আগে আয়োজকদের ফেসবুক বিজ্ঞপ্তি জানান দিচ্ছে অনুষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বিলম্বিত হয়েছে আসন্ন পরীক্ষার মরসুমের জন্য, ব্যাস, ব্যাস এটুকুই।
এর শুরুয়াদ মোটেই এইভাবে ছিলোনা, রীতিমত ঢাক ঢোল পিটিয়ে বিজ্ঞাপন বাগিয়ে হৈ হৈ করে চলছিলো হাজারে হাজারে টিকিট বিক্রির পালা। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে টেলিভিশন যেকোনো পর্দায় চোখ রাখলেই দেখা যাচ্ছিলো স্ক্রীন ভর্তি উত্তেজনার চলচ্চিত্র। এমনকি যে ছটা প্রখ্যাত বাংলা ব্যান্ডের মহামিশেলে এই অনুষ্ঠান, তাদের প্রত্যেকের ফেসবুকের পাতায় দ্যাখা মিলেছে বিজ্ঞাপনী থিম সঙ্গীতের। কিন্তু অনুষ্ঠান বাতিল হওয়ার পরেই আর “তোমার দ্যাখা নাই রে, তোমার দ্যাখা নাই”। ফেসবুকের ১০০ শব্দের দ্বি-ভাষী বিজ্ঞপ্তি ছাড়া সবাই কেমন স্পিকটি নট। কিন্তু এই পরিমাণ ঢাক ঢোল এমনকি ফেসবুক ইনস্টাগ্রামের পেইড অ্যাডস পেটানোর পরে এই দাবী করারও কোনো পরিসর থাকেনা যে অনুষ্ঠানের আয়োজকরা অপটু, উপরন্তু তারা বেশ পরিচিত নাম এপার বাংলার কনসার্ট আয়োজন জগতের। তারপরেও শব্দহীনতা ও উপেক্ষা ছাড়া তারা ১২ই ফেব্রুয়ারি ২০২৩ এ আর কিছুই দিতে পারলেন না, উডস্টক বহুদূর! আয়োজকদের উচিত ছিল উডস্টক’এর সঙ্গে সঙ্গে একটি সাল’ও উল্লেখ করে দেওয়া, যাতে আপামর জনসাধারণের বুঝতে আগেভাগেই সুবিধা হয় ব্যাপারটা কোনদিকে যাচ্ছে। ‘৯৯ এর উডস্টক এর মতোই আয়োজকদের পূর্বপ্রস্তাবিত বিধিনিয়ম অনুযায়ী এখানেও খাবার, জল এসব নিয়ে ঢোকায় বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েই গেছিলো, এমনকি আট ঘণ্টায় একবারো ভেন্যু ছেড়ে বেরোনোতেও নিষেধ, তাই অনুষ্ঠানটা শেষমেশ হলেও তার আফটারশক কতদূর গড়াতে পারতো সে এক ভিন্ন আলোচনার বিষয়। এই পরিমাণ গাফিলতির নির্দশন রেখেও নিজেদের ফেসবুকের পাতায় ক্রুদ্ধ জনতাকে কমেন্ট বাক্সে শব্দের চিমটি কাটতেও তারা পিছপা হননি, দুঃখিত হওয়া বহুদূর। শব্দটা সংক্ষিপ্ত ফেবু বিজ্ঞতিতে স্থান পেলেও চেতনায় কাহাতক পেয়েছে তা বাংলা সঙ্গীত শ্রোতার গবেষণার বিষয় হতে পারে বৈকি!
তবে আয়োজকদের অনুষ্ঠান বাতিল করায় বিশেষ লাভের মুখ খোঁজা ততোটাই অযৌক্তিক যতোটা প্রেম দিবসে গরুকে জাপটে ধরার প্রস্তাবনা, তাই উল্টোদিকটাও খতিয়ে দেখা সমান ভাবেই প্রাসঙ্গিক। কিভাবে একটা মহা অনুষ্ঠান আয়োজনের ৩৬ ঘণ্টা আগেই মহামহিম কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের হঠাৎ চিত্ত জাগরণ ঘটে এবং তারা দেশের কিশোর যুবকের পড়শোনার কথা মনে করে ফেলে ধাই করে এক নোটিশ ঠুকে দেন সে বিষয়ে জেমস বন্ড না হোক নিদেনপক্ষে ফেলুদার মগজাস্ত্র’এর চেয়ে কম কিছুর প্রয়োগে করে উত্তর খুঁজে পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। যে পরীক্ষার কথা বলে অনুষ্ঠানের অনুমতি বাতিল হচ্ছে তা এসে পৌঁছতে এখনো সপ্তাহ দুই বাকি কিন্তু অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু হয়েছে মাস দুই তো হবেই! তবে?
তবে ওই, অপসংস্কৃতি, ট্র্যাফিক জ্যাম, লিগ্যাল নোটিশ এর পচা বস্তাটা ছুঁড়ে দেওয়া প্রজন্মের কাঁধে। “সব ক্রুশ কাঁধে নিতে রাজি” প্রজন্ম রাত জেগে, দিনে খেটে, মালদা মুর্শিদাবাদ আরো কতো মফঃস্বল কি শহরতলি থেকে মনে মনেই জোট বেঁধে ফেলছিলো নিজেদের কষ্টার্জিত টাকার টিকিট কেটে। ট্রেনের টিকিট থেকে হোটেলের ঘর সবটাই জোগাড় করে নিচ্ছিলো নিজে থেকেই। চাকরির খোঁজে রাস্তায় বসা এক প্রজন্ম, মাঝরাতে বিছানাতে হেডফোন লাগিয়ে ব্যান্ড সমুদ্রে ডুবে যেতে চাওয়া প্রজন্ম, সব আছে অথচ কিছুই নেই এর প্রজন্ম। তাদেরও তো এক ঝলক ঠান্ডা হওয়ার দরকার ছিলো। তাদের দরকার ছিলো একটা ডকু ফিচার ছবি ব্যান হয়ে যাওয়া দেশে, একটা নাট্যকর্মীর মার খাওয়া রাজ্যে মস্তিষ্কের মড়ক পেরিয়ে বেচেঁ ওঠার এক সঞ্জীবনী। কিন্তু জুটলো কপালে হয়রানি। রাজায় রাজায় ঠান্ডা যুদ্ধ হওয়া মহাপৃথিবীতে জেনারেল বগিতে বসে গরমে ঘামতে ঘামতে কলকাতায় পৌঁছেও প্রজন্ম ছুঁতে পারলো না তার উজ্জীবনের পরশকাঠি। তাই এই বিলম্বিত ব্যান্ডেমিকের দায়ভার আয়োজকপক্ষ বা কর্তৃপক্ষ যারই হোক, ভুগছে দারুণ ভাবেই শ্রোতাপক্ষ। কনসার্ট শিল্পীর মৃত্যু নেমে আসা তিলোত্তমার বুকে summer of 69 এর উডস্টক নেমে আসার গল্প এখনো কল্পনাই। উল্টে আমরাই বানিয়ে ফেলি নতুন একটা অভ্যাস, শিল্পীদের গ্রেপ্তার করে কণ্ঠরোধের অভ্যাস, রাতারাতি নাট্যমেলা বাতিলের অভ্যাস, কলমের খোঁচা দিয়ে স্বপ্ন ভঙ্গের অভ্যাস আর, সংস্কৃতি এবং সংস্কৃতিমনস্কের উপর কারফিউ জারির অভ্যাস। শুধু আশাটুকুই করি যে এসব অভ্যাসও একদিন “we shall overcome”, সেদিন নাহয় শিল্পহীনতার প্যান্ডেমিক কাটিয়ে আমারও ব্যান্ডেমিক’এ পৌঁছে যাবো।
অঞ্জন দত্ত পেরিয়ে ফসিলস-ক্যাকটাস শুনে বেড়ে ওঠা একটা প্রজন্ম তাই আপাততঃ উডস্টক কাটিয়ে কাঠগোদামেরই কাঠে হোঁচট খাক। অন্য কোনো তারিখে হয়তো হবেই ‘আমাদের উডস্টক’-এর উদযাপন। আপাতত সামনে আরো অনেকগুলোই অন্ধকার রাত, ২৩ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারির আলিঙ্গন দিবসে বাংলার গান পাগলদের জাপটে ধরুক একরাশ অভিমান আর না পাওয়াই। গোলাপ কিংবা উডস্টক তো আর জুটছে না, বাংলার উডস্টক থুড়ি কাঠগোদামের কাঠগোলাপেই কুঁকড়ে থাকুক ভালোবাসা, এবার প্রেম দিবসে? – এলাকা কাঁদবে!
সম্পাদকীয়তে প্রতিফলিত বক্তব্য এবং মতামত একেবারেই লেখকের ব্যক্তিগত। এর দায় ডেইলি নিউজ রিল কর্তৃপক্ষ নেবে না।
Discussion about this post