দিনটা ১৭ আগস্ট। শ্রীরামপুর কলেজে বেশ বড়সড় মাপে অনুষ্ঠান হয় ওইদিন। ওইদিন যে উইলিয়াম কেরীর জন্মদিন। ১৭৬১ সালের ঠিক এই দিনেই ইংল্যান্ডের পউলার্সপিউরি নামক ছোট্ট এক গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন উইলিয়াম কেরী। স্বদেশ ছেড়ে বিদেশ বিভুঁইয়ের মাটিতে এসে সেদেশের ভাষা শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রেমে পরেগেছিলেন তিনি। অচেনা জায়গা, অসহ্য আবহাওয়া, অজানা ভাষা, অদ্ভুত সব লোক তাঁর মনে নিশ্চয়ই এগুলো ঘুরেছিল। কিন্তু তাও তিনি দমে যাননি। তিনি বুঝেছিলেন ধর্ম প্রচারের জন্যেই যে সেই দেশের ভাষা সম্পর্কে জ্ঞানের প্রয়োজন এবং আরো প্রয়োজন নেটিভ ভাষায় তাদের আদর্শকে ছড়িয়ে দেওয়া। তাই কলকাতার বুকে তিনি এসবের জন্য কিছুটা চেষ্টা করলেন, কিন্তু উল্টে কোম্পানির বিরাগভাজন হয়ে পড়লেন। তাই বাধ্য হয়েই শ্রীরামপুরে পালিয়ে আসা। সেখানে আরো দুজন পাদ্রী ও তাদের পরিবারের সাহায্য পেলেন। গড়ে উঠলো শ্রীরামপুর মিশন। ভাগীরথীর পাশেই গড়ে তোলা হলো একটি ব্যাপ্টিস্ট চার্চ। ওটাই হয়ে ওঠে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের মূল ঘাঁটি। তবে সেখান থেকে কেরী সাহেব ও তার সহযোগীরা বাংলা ভাষাকে যা দিলেন তা ভুলে যাওয়া অসম্ভব।
শ্রীরামপুর মিশন প্রেস গঠন করে তারা কাজ শুরু করলেন। ছোট্ট একটি ভাড়া বাড়িতে কাজ শুরু, সেখান থেকে এটি হয়ে যায় এশিয়ার বৃহত্তম ছাপাখানা। বাংলা ভাষা, হরফ, লিপি, সাহিত্যের আঁতুরঘর হয়ে ওঠে শ্রীরামপুর। ১৮০০ সালের মার্চে মতীয়ের রচিত ‘মঙ্গল সমাচার’-এর প্রথম পাতাটি মুদ্রিত হয় যা পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রূপে আগস্ট মাসে প্রকাশ পায়। তারপর ১৮০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ধর্ম পুস্তক নামে নিউ টেস্টামেন্টের বাংলা অনুবাদ মুদ্রিত হয়। বাংলা সাহিত্যে এটাই ছিল প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা ভাষার গদ্য।
১৮০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে উইলিয়াম কেরীকে সেখানকার বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেখানেই কেরী সাহেব একদল পন্ডিত গোষ্ঠীকে সংগঠিত করলেন যারা একের পর এক রচনা করলেন সরল বাংলা ভাষার গদ্য পুস্তিকা। ১৮০১ সালে কেরী সাহেবের মুন্সি চুঁচুড়ার বাসিন্দা রামরাম বসু রচনা করলেন ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’। এটি ছিল একক ভাবে রচিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ আধুনিক বাংলা অক্ষরের পুস্তক। এরপর ১৮০২ সালে তিনি লিপিমালা ও ১৮১২ সালে ‘খৃষ্টবিবরণামৃতম্’ রচনা করেন। উইলিয়াম কেরী ১৮০১ সালে ‘বেঙ্গলি গ্রামার’ (প্রথম সংস্করণ) রচনা করেন। খ্রিস্টীয় শিক্ষা বাদ দিলে এটাই ছিল তাঁর লেখা প্রথম বাংলা ব্যাকরণের পুস্তক। তাছাড়া কথোপকথন (১৮০১), বেঙ্গলি গ্রামার; দ্বিতীয় সংস্করণ (১৮০৫), ইতিহাসমালা (১৮১২) প্রভৃতি রচনা করে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেন। ভাষা সাহিত্যের পাশাপাশি অবশ্য তিনি সমাজিক বিষয় নিয়েও যথেষ্ট চিন্তাশীল ছিলেন। চড়কে ঝোলানো, সতীদাহ প্রথার বিরোধিতা হোক বা স্ত্রী শিক্ষা প্রসারের সমর্থন। তিনি এবং তাঁর সঙ্গীরা এবিষয়ে যথেষ্ট উদ্যোগী হয়েছিলেন। রাজা রামমোহন রায়ের সাথে তাঁর মতানৈক্য হলেও তাঁর দুজনেই সতী প্রথার সমাপ্তি চেয়েছিলেন। চড়ক প্রথা নিবারনের জন্য তিনি শ্রীরামপুরের তৎকালীন দিনেমার গভর্নরকে অনুরোধ করেন।
তবে উলিয়াম কেরীর সর্বাপেক্ষা বৃহৎ উদ্যোগ ছিল বাংলার বুকে এশিয়ার দ্বিতীয় প্রাচীনতম কলেজ তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপন। শ্রীরামপুরের বুকে ভাগীরথীর পারে গড়ে একটি ছোট্ট বাড়িতে গড়ে ওঠে শ্রীরামপুর কলেজ। ধর্ম-জাতি নির্বিশেষে এই কলেজে সবার প্রবেশাধিকার ছিল এবং বিজ্ঞান ভিত্তিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারেও এটি ছিল অনন্য। তাঁর অবদানকে স্মরণে রেখেই প্রত্যেক বছর এই দিনটায় অনুষ্ঠিত হয় কেরী দিবস। প্রত্যেক বছর সাজানো হয় শ্রীরামপুর কলেজকে। অন্য রাজ্য ও বিদেশ থেকে আসেন অতিথিরা, চলে বিভিন্ন অনুষ্ঠান। তাই কেরী দিবস শ্রীরামপুর কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কাছে কোনো অংশে উৎসবের চেয়ে কম নয়।
Discussion about this post