রোজকার আকাশে মধ্য গগনের সূর্যেরই মত ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে মাস্টারদা। অবিভক্ত বাংলার নয়াপাড়ায় জন্ম। কর্ণফুলির ধারে এ গ্রামের মাটি কি আর জানতো এমন মানুষ জন্মাবে তার বুকে! স্কুলে পড়াকালীন প্রথম দেখেন বিদ্যাসাগরের ছবি। তাঁর মাস্টারমশায় আবৃত্তি করছেন নবীন চন্দ্র সেনের কবিতা। সেসব কবিতা তখন অদ্ভুত উত্তেজনা হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে আজকের সূর্য সেনের ভিতরে। এরপর চট্টগ্রামে এসে তার হাতে পরে দেউস্কের ‘দেশের কথা’, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’। পড়ার দিকে মন আরও ঝোঁকে তাঁর। বড় হবার সাথে সাথে ওয়ার্ডসওয়ার্থ, গিবন থেকে শুরু করে তার ভালো লাগতে থাকে আয়ারল্যান্ডের বিপ্লবী জন মিচেলের আত্মত্যাগের কাহিনী।
এই বুঝি দেশপ্রেম গেঁথে নেওয়ার সূচনা। শিক্ষক হয়ে তিনি যোগ দিলেন উমাতারা উচ্চ বিদ্যালয়ে। ছাত্রদের কাছে হয়ে উঠলেন ‘মাস্টারদা’। দেশ জুড়ে সে সময়ে ইংরেজ অত্যাচারের উত্তাপ। ‘ভারতী’ তে তখন প্রকাশ হচ্ছে শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবি’। গোপন আস্তানায় হ্যারিকেনের আলোয় মাস্টারদা পড়লেন সেই লেখা। তারপরই গ্রেফতার করে তাকে চালান করা হলো রত্নগিরি জেলে। সেখানে গিয়েও তিনি এ উপন্যাসের কথা বলতেন। তার কথা ছিল সাহিত্য মনকে সজীব রাখে। তবে সজীবতার কাছেও আসে পাতা ঝরার কাল। ঠিক সেভাবেই ইন্ডিয়ান পেনাল কোড ১২১/১২১ ধারা অনুযায়ী তাঁর ওপর ট্রাইব্যুনালের মামলা দায়ের করা হয়। ফাঁসির দিন ঠিক হয় ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি।
ফাঁসির মঞ্চে সূর্য সেনকে তোলা হয়নি। বরং তোলা হয়েছিল তার নিথর দেহকে। উপড়ে নেওয়া দাঁতের আঘাত তখনও দগদগে। তবে ফাঁসির আগে তাঁর ইচ্ছে ছিল গান শোনার। গানই বয়ে আনে মুক্তি। বন্দি থাকা অবস্থায় এক মেথর কয়েদি মারফত চিঠি পাঠিয়ে তিনি এ ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। তবে জেলে তাকে গান শোনাবে কে? ঠিক ওই সময়েই তাঁর সঙ্গে জেলে ছিলেন বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী। আর মেয়েদের জেলে ছিলেন কল্পনা দত্ত। একদিন রাতে ১১/১২ টা। কল্পনা বিনোদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলেন, ‘ওরে মাস্টারদা যে গান শুনতে চেয়েছেন রে।’ বিনোদ বিহারী গান জানতেন না। তবে অবশেষে ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ গানটাই মাস্টারদাকে শুনিয়েছিলেন বিনোদ।
একলাই চলতে হয় জীবন পথে। এ কথা তিনি জানতেন। তবু তিনি ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ দেবার আগে চিঠি লিখে যান। আর তাতে বলেন, তাঁর জীবনে সকলের সঙ্গ তাঁর মধুর স্মৃতি। বাকিদের এগিয়ে চলার উৎসাহ দিতে কখনো পিছপা হননি তিনি। মৃত্যুর মুহূর্তে জীবনে মায়া তাকে যাপটে ধরতে চাইলেও স্বাধীনতার স্বপ্ন তাঁকে জড়িয়ে রেখেছিলো। আদর্শকে পাথেয় করে সঙ্গীদের মাঝে স্বাধীনতার স্বপ্ন জাগিয়ে রাখার ক্ষমতা মাস্টারদাকে আজও জ্বলন্ত সূর্য করে রেখেছে।
Discussion about this post