৪০ দিন ধরে বন্ধ রাস্তার আলো। তবু কারুর মনে কোনও ক্ষোভ নেই৷ নেই কোনও অভিযোগও। বরং তারা খুশিই৷ কারণ নিজেরাই তো চেয়েছিলেন তা। কারণ? সামান্য এক পাখি। ছোট্ট পাখিটির সুবিধার্থেই রাস্তার মোড়ের আলোর পরিষেবা বন্ধ করা হল। শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি! ঠিক এমন ঘটনাই ঘটেছে তামিলনাড়ুর শিবগঙ্গা জেলার পোত্তাকুড়ি গ্রামে। এক ম্যাগপাই-রবিন পাখির জন্য সেই গ্রাম টানা ৪০ দিন ধরে বন্ধ করে রেখেছে তাদের রাস্তার আলো। বিষয়টির নেপথ্যে রয়েছেন আলোর পরিষেবা দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা গ্রামেরই এক বাসিন্দা এবং গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান। দুজনের মিলিত উদ্যোগেই এখন শান্তিতে নিজের বাসা বেঁধেছে রবিন পাখিটি। মানবিকতার এমনই এক নজির মিলল দক্ষিণের সেই গ্রামে।
পোত্তাকুড়ি গ্রামের রাস্তার আলোর প্রধান সুইচবোর্ডের বাইরে একদিন উড়ে আসে এক রবিন পাখি। পরিষেবার দায়িত্বে থাকা সেই গ্রামেরই বাসিন্দা করুপ্পু রাজার নজরেই প্রথম আসে বিষয়টি। কৌতুহলী হয়ে একটু খতিয়ে দেখতেই তিনি দেখেন পাখিটি সুইচবোর্ডের আশেপাশে খড় এবং গাছের ডালের কুটোকাটা সংগ্রহ করে এনেছে। সম্ভবতঃ নিজের বাসা বানানোর জন্যই এই কাজটি করে পাখিটি। এরপর যখনই রাজা সুইচবোর্ড চালু করতে যেতেন পাখিটি ভয়ে, প্রাণ বাঁচানোর তাগিদেই সেখান থেকে উড়ে পালাত। চারদিনের মাথায় তিনি লক্ষ্য করেন পাখিটির বাসায় সবুজ-নীল রঙের দাগযুক্ত ছোট্ট ছোট্ট তিনটি ডিম। সেটি দেখেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন পাখিটির বাসাটি সুরক্ষিত রাখার জন্য সুইচবোর্ড আর চালু করা যাবে না৷ অর্থাৎ এর ফলে সেই গ্রামের প্রায় ৩৫ টি রাস্তার আলো আর জ্বালাতে পারবেন না তিনি। কিন্তু তার ফলে সমস্যায় পড়তে পারে গ্রামের সাধারণ মানুষজন। বিষয়টি গ্রামের মানুষকে জানানোর জন্য তিনি পাখিটির বাসার একটি ছবি তুলে এলাকার বাসিন্দাদের দেখান এবং সম্পূর্ণ বিষয়টি তাদের বোঝান। গ্রামের মানুষও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয় আলো বন্ধের সেই প্রস্তাবে। তবে সবাই যে রাজি হয়েছিলেন তা কিন্তু নয়৷ গ্রামের কিছু কিছু মানুষ এর বিরোধিতাও করেন। তারা মনে করেছিলেন সামান্য এক পাখির জন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়া কিছুটা বোকামিই বটে! এরপর রাজা গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানের কাছে গিয়ে ঘটনাটি জানান এবং আলো বন্ধ রাখার জন্য সম্মতি দেওয়ার অনুরোধও জানান। পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখার পর পঞ্চায়েত প্রধানও সেই প্রস্তাবেই রাজি হন। সকলের সম্মতিতেই এরপর আলোর প্রধান সরবরাহের তারটি কেটে দেওয়া হয়৷ এছাড়াও পাখিটি এবং তার ডিমের সুরক্ষার জন্য সারারাত জেগে পাহারা বসানোরও ব্যবস্থা করেন তারা।
আপাততঃ গত ৪০ দিন ধরে সেই বাসাতেই রয়েছে পাখিটি। ইতিমধ্যেই ডিম ফুটে তিনটি ছোট্ট বাচ্চাও হয়েছে। তবে এখনও চালু করা হয়নি আলো। পঞ্চায়েত প্রধানের মতে পাখিটি তার বাচ্চা সমেত সেখান থেকে চলে যাওয়ার পরই আবার গ্রামটি আগের ছন্দে ফিরবে। ততদিন পাখি এবং বাচ্চাদের সুরক্ষার চিন্তাতেই বিভোর গোটা গ্রাম। এই পুরো ঘটনাটিই আমাদের একটা শিক্ষাই দিয়ে যায়। আমাদের চারপাশে ঘটে চলা এত হানাহানির মাঝেও কিন্তু বেঁচে রয়েছে এমন কিছু ভালবাসার গল্প। যেখানে মানুষ আক্ষরিক অর্থেই শেখাচ্ছেন মানবিকতার পাঠ। সামান্য এক পাখির জন্য সারা গ্রামের এই উদ্যোগ আগামী দিনের জন্য এক দৃষ্টান্ত হিসাবেই রয়ে গেল। আর সেই সঙ্গে মন জয় করে নিল আমাদেরও।
চিত্র ঋণ – The Better India
Discussion about this post