প্রাচীনকাল থেকে এখনও পর্যন্ত সমগ্র বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যে সমস্ত গুণীজনের নাম না বললেই নয়, তাঁদের মধ্যে অন্যতম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। পেশায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র। বাংলার প্রথম আধুনিক ঔপন্যাসিক। বাংলা ভাষার আদি সাহিত্যপত্র ‘বঙ্গদর্শনে’র সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র। ‘সাহিত্য সম্রাট’ বঙ্কিমচন্দ্র। যে বঙ্কিমচন্দ্রকে শ্রদ্ধা করতেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এই বঙ্কিমচন্দ্রই নাকি ফেল করেছিলেন বাংলা বিষয়েই! আর তার চেয়েও আশ্চর্যের কথা হল, কম নম্বর দিয়ে নাকি ফেল করিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর!
বিদ্যাসাগর তখন শিক্ষাবিস্তার এবং সমাজ-সংস্কারমূলক নানা কর্মকান্ডের মধ্যে যুক্ত। তাঁর থেকে আঠেরো বছরের ছোটো হলেন বঙ্কিমচন্দ্র। প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রথমবার বিএ পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। পরীক্ষার্থী সংখ্যা মাত্র দশজন। তার মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র একজন। বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ। খাতা দেখার কাজ তাঁর। বিএ পরীক্ষায় বাংলা পত্রে ফেল করলেন বঙ্কিমচন্দ্র। শেষ পর্যন্ত তাঁকে গ্রেস নম্বর দিয়ে পাস করানো হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র হলেন বাংলার প্রথম গ্র্যাজুয়েট। কিন্তু, লোকে বলে এরপর থেকে নাকি বঙ্কিমচন্দ্র আর বিদ্যাসাগরের সম্পর্ক ছিল সাপে-নেউলে। সমস্ত বড়ো মানুষদের নিয়ে গুজব তৈরি অতি সাধারণ বিষয়। এই দুই মনিষীও তার থেকে বাইরে নন।
বঙ্কিম ও বিদ্যাসাগরকে নিয়ে রয়েছে অনেক গল্প। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসের সূর্যমুখী চরিত্র বলে, “ঈশ্বর বিদ্যাসাগর নামে কলকাতায় কে না কি বড়ো পন্ডিত আছেন। তিনি আবার একখানি বিধবা বিবাহের বহি বাহির করিয়াছেন। যে বিধবা বিবাহের ব্যবস্থা দেয়, সে যদি পন্ডিত, তবে মূর্খ কে?” এই সমালোচনাকে বিদ্যাসাগর হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন লোকসমক্ষেই। বলেছিলেন, “না হে না। বঙ্কিমের সূর্যমুখী আমার মত মূর্খ দেখেনি।“ বিদ্যাসাগরের সামনে কেউ বঙ্কিমের কুৎসা করলেও তাকে বুদ্ধি করে এড়িয়ে গেছেন বিদ্যাসাগর। সেই একই শ্রদ্ধা এবং সম্মান বঙ্কিমচন্দ্রও দেখিয়েছেন বিদ্যাসাগরের প্রতি। কেউ অপমান করলে চোখ রাঙ্গিয়ে বলেছেন, “তুমি জানো ইনি কে? ইনি বিদ্যাসাগর! এক্ষুনি ক্ষমা চাও।”
দুইজনে দুই ভিন্ন পরিবেশের পারিপার্শ্বিকতায় বেড়ে উঠেছিলেন। দুজনের ভাবনাচিন্তা, মূল্যবোধ ছিল স্বাভাবিকভাবেই ভিন্ন। দুজনেই উনিশ শতকের রেনেসাঁসের আলোয় আলোকিত ছিলেন এবং আলোকিত করে গেছেন সমাজকে। বয়সের অনুপাত বিচারে তাঁদের মধ্যে মতবিরোধ ছিলই। কিন্তু সেই বিরোধ দুইজনের শালীনতা বা কাজের মধ্যে কখনোই অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি।
Discussion about this post