খুব প্রচলিত একটি প্রবাদ ‘শাড়িতেই নারী’। বাড়ির মা-কাকিমা-জেঠিমাদের মুখে প্রায়ই শুনি। একদিন সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম যে এই প্রবাদটার ভেতরের অর্থ কি? তাঁদের কাছে থেকে এই প্রবাদের আসল অর্থ সেদিন বুঝলাম। বাঙালি নারীর জীবনে আসলে শাড়ি চিরকালই এক ভিন্ন জায়গা দখল করে রেখেছে। আর শুধু বাঙালি নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ নারীর কাছেই শাড়ি একটা আলাদাই আবেগ। প্রবাদের অর্থটা খানিক এই রকম; নারীর আভিজাত্য, মর্যাদা, গাম্ভীর্য এক লহমায় বাড়িয়ে দেয় এই শাড়ি। কিশোরীর পরনের শাড়িও তাকে মুহূর্তের মধ্যেই যৌবনের আভাস দিয়ে যায়। তবে এটা একদমই নয় যে, আমি নারীদের অন্য পোশাককে ছোট করছি। আজ বরং এই শাড়ির ইতিহাস ,রকমফের, বুনন, স্থান ভেদে তার রূপের কী পরিবর্তন হয় সেই নিয়েই না হয় একটু আলোচনা হোক।
মূলতঃ ধারণা করা হয় যে ‘শাড়ি’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘শাটি’ থেকে। যদিও এই নিয়ে পন্ডিতদের রয়েছে অনেক মতভেদ। আমি সেই তর্কে যেতে চাই না। তবে মধ্যভারতীয় আর্যদের ভাষায় শাড়ীর সমার্থক শব্দ মেলে ‘সটিকা বা সাটক’। আবার একটু সরে এসে যদি ঋগবেদের দিকে নজর দিই তাহলে দেখা যায় খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ বছর আগেও শাড়ির উল্লেখ আছে। তার প্রমান পাওয়া যায় সেই সময়ের মূর্তি থেকে। মূর্তির গায়ে জড়ানো থাকতো এক প্রকার দীঘল কাপড়। যাকে পরিধেয় বস্ত্র বলা হতো। তখনকার সময়ে শাড়ির আক্ষরিক অর্থ ছিল ‘পরিধেয় বস্ত্র’। নারীরা এক দীঘল কাপড় তাদের সর্বাঙ্গে জড়িয়ে নিত। শাড়ির ইতিহাস এখানেই শেষ নয় – বরং বলা যেতে পারে সবে তো কলির সন্ধ্যে! এখনও অনেক গল্প বলা বাকি।
আনুমানিক ৩০০ থেকে ৫০০ সাল, তখন চলছে গুপ্তযুগ। মহাকবি কালিদাসের অমূল্য সৃষ্টি ‘কুমারসম্ভব’, সেখানেও আছে এই পোশাকের উল্লেখ। এছাড়া অজন্তা ইলোরার গুহা চিত্রে এর অনেক নিদর্শন মেলে। পাহাড়পুর ও ময়নামতীর পোড়ামাটির ফলক থেকে আমরা পাই যে পূর্ববঙ্গেও শাড়ির চল ছিল। তবে এ বিষয়ে একটা কথা বলার যে, প্রাচীনকালে কিন্তু বর্তমানের মতো এভাবে শাড়ি পড়ার চল ছিল না। ঐতিহাসিক নিহাররঞ্জন রায়ের মতে পুরাকালে পূর্ব-দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে মূলতঃ একখণ্ড কাপড় গায়ে জড়িয়ে নিয়ে নিজেকে আবৃত রাখারই চল ছিল। শাড়ি পড়ার ধরণে আমূল পরিবর্তন প্রথম এনেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদা নন্দিনী দেবী। তিনিই প্রথম উন্মুক্ত বক্ষ নিয়ে শাড়ি পড়ার বিরোধ করেন। তাঁর হাত ধরেই আসে অন্তর্বাস, ব্লাউজ পড়ার রীতি। বাঙালি নারীর পোশাকের ইতিহাসে শুরু হল এক নবজাগরণের।
শাড়ির কথা তো আমরা বললাম কিন্তু তা ভারতীয় সংস্কৃতির ধারক ও বাহক কিভাবে হলো এখন সেটাই বলার। ভারতীয় সংস্কৃতিকে প্রধানতঃ তিনটি মূল স্তম্ভে সাজানো যায়। প্রথম, হিন্দুস্থানী যা প্রধানত বর্তমানে পাকিস্তান ও উত্তর ভারতকে বোঝায়। দ্বিতীয়, কর্ণাটকী যা দক্ষিণ ভারতকে চিত্রিত করে। তৃতীয়, পূর্বভারতীয় যা আমাদের বাংলা, বিহার উড়িষ্যাকে ধারণ করে। এই সংস্কৃতির যে এত বৈচিত্র্য তা নারীর পরিধেয় শাড়ী দ্বারাই সবথেকে বেশি বোঝা যায়। যেমন কেউ শাড়ি পড়েন প্যাঁচে আবার কেউ আঁচল দিয়ে। অনেক জায়গায় ধুতির আদলে শাড়ি পড়ার চল আছে, অনেক জায়গায় ঘাগড়ার মতো করে শাড়ির পরিধান হয় ইত্যাদি ইত্যাদি।
শাড়ির রকমফেরের গল্প তো আসলে শেষ হওয়ার নয়। গঙ্গা নদীর ধারে বেনারসের বেনারসি শাড়ি, কেরালার বিশেষ ঢঙের শাড়ী, পশ্চিমবঙ্গের বালুচরী। এছাড়াও জামদানি, কাঁথাস্টিচ, লিনেন, সিফন, তাঁত , ইক্কত আরও কত বাহারি তার নাম।
পোশাক হিসাবেই শুধু নয় শাড়ী ধীরে ধীরে হয়ে উঠলো সংস্কৃতির সর্বোত্তম পরিভাষা। একটা সময় ঢিলে ঢালা আরামদায়ক পোশাক হিসাবেই ব্যবহৃত হওয়া এই শাড়ী আজ নারীর অভিমানের মর্যাদার এক পরিভাষা, পরিপাটি এক রূপ পেলো। ‘শাড়ীতেই নারী’ এভাবেই পেল সার্থকতা।
Discussion about this post