শিল্প ও সংস্কৃতিতে বিশ্বজুড়ে বাংলার খ্যাতি ছড়িয়ে রয়েছে। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের বহু হস্ত ও কুটির শিল্প গ্রাম বাংলার অন্যতম সম্পদ। সত্যি বলতে গেলে, সময়ের সাথে সাথে বাংলার বুক থেকে অনেক শিল্পকর্মই ক্রমে লুপ্ত হতে বসেছে। তবে কিছু লোকশিল্প এখনও তার গরিমা এবং ঐতিহ্যকে সম্বল করে বাংলার বুকে বেঁচে রয়েছে। বর্তমানে তার মধ্যে অন্যতম বাংলার মুখোশ শিল্প। মুখোশের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ আজকের নয়। সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক আয়োজনে মুখোশ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার একটি প্রাচীন সংস্কৃতি হল এই মুখোশ। বহু প্রাচীন এই শিল্প কয়েক শতাব্দী ধরে প্রবাহমান। দিনাজপুর জেলার কুশমন্ডি গ্রামের খ্যাতি কাঠের মুখোশ তৈরির জন্যই। স্থানীয় ভাষায় এই মুখোশকে বলা হয় মুখ।
কুশমন্ডি ব্লকের মহিষবাথান, বেরাইল, ঊষাহরণ, দেহাবন্দ ইত্যাদি গ্রাম ঐতিহ্যবাহী মুখোশের জন্য বিখ্যাত। একটি কাঠের পিণ্ডকে ছেনি হাতুড়ি দিয়ে কেটে শিল্পীরা তৈরি করেন মুখোশ। এমনকি বাঁশ কেটেও তৈরি হয় নানান ধরনের মুখোশ ও কারুকার্য। এই মুখোশগুলিকে গোমিরা মুখোশও বলা হয়। কারণ, মুখোশগুলি সাধারণত গোমিরা নাচের জন্যই ব্যবহৃত হয়, যা একটি স্থানীয় লোকনৃত্য। কুশমন্ডির রাজবংশী সম্প্রদায়ের কাছে এই কাঠের মুখোশগুলির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ধর্মবিশ্বাসও। জানা যায়, রাজবংশীদের দেশী ও পোলি সম্প্রদায়ের বিদ্বেষমূলক আচরণের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল গোমিরা নৃত্যচর্চা। ফসল কাটার মরসুমে ‘অশুভ শক্তি’ তাড়াতে মুখোশ পরে চলে গোমিরা নাচ। সেই নৃত্যশিল্পীদের জন্যই তৈরি করা হয় এই মুখোশ।
এই মুখোশগুলি সাধারণত কাঠ, বাঁশ বা মাটি দিয়ে তৈরি করা হয় এবং বিভিন্ন ধরনের নকশা ও রঙ দিয়ে সজ্জিত করা হয়। শিল্পীরা মূলত গামার গাছের কাঠ থেকে এই মুখোশ তৈরি করেন। প্রথমে, কাঠ অথবা বাঁশকে মুখোশ বানানোর উপযোগী করে তুলতে জলে ভিজিয়ে পোক্ত করা হয়। তারপর সেগুলি জল থেকে তুলে দীর্ঘ সময় রোদে শুকানো হয় এবং মুখোশের মাপ অনুযায়ী কেটে নেওয়া হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে তার ওপর নকশা এঁকে নেওয়ার পালা। এরপর বাটালি ও ছেনি দিয়ে কাঠ বা বাঁশের টুকরোটির ওপর খোদাই করে তাকে মুখোশের রূপ দেন শিল্পীরা। শেষ পর্যায়ে মুখোশটিকে রং ও বার্নিশ করা হয়। প্রথমদিকে বিভিন্ন ফুল ও ফল থেকে নিঃসৃত প্রাকৃতিক রঙ দিয়েই এই মুখোশ রঙ করা হত। এখন যদিও মুখোশ শিল্পীরা বাজার চলতি রাসায়নিক রঙই বেছে নিয়েছেন।
কুশমন্ডির কাঠের মুখোশ তৈরির শিল্পটি বংশ পরম্পরায় স্থানীয় শিল্পীরা এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। অতীতে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত গোমিরা নাচের প্রয়োজনে প্রচলিত হলেও বর্তমানে ঘর সাজানোর উপকরণ হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয় এই মুখোশ। বর্তমানে এই গ্রামের শিল্পীদের তৈরি কাঠের রংবেরঙের মুখোশ বাংলার গণ্ডি ছাড়িয়ে সারা ভারতেও প্রসারতা লাভ করেছে। এমনকি বেশ কয়েক বছর ধরে বিদেশেও পাড়ি দিচ্ছে কুশমন্ডির মুখোশ। এই শিল্পটি স্থানীয় অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কুশমন্ডির মুখোশ শিল্প পেয়েছে AIACA প্রদত্ত ক্রাফটমার্ক। তাই এই শিল্প আজ আর শুধু জেলা নয়, রাজ্য তথা দেশের গর্ব।
Discussion about this post