হাল আমলের আধুনিক কলাকৌশল ও পণ্যের কাছে মার খেতে খেতে বাংলার অনেক ঐতিহ্যবাহী পণ্য আজ বিলুপ্তির পথে। যুগ যুগ ধরে বাংলার বহু জিনিস শুধু বাংলাতেই নয় বরং গোটা দেশে ছাপ ফেলেছিল। অথচ আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কজনই বা জানি সেসব কথা! এই হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যগুলির কথা বলতে গেলে বাঁকুড়ার রাজগ্রামের বিখ্যাত ‘বাঁকুড়া গামছার’ কথা না বললেই নয়। সাধারণের কাছে এই গ্রাম খুব পরিচিত না হলেও সেই সময় দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসতেন শুধুমাত্র এই গামছার জন্যই। বাংলার গামছা বলতে তখন সকলে রাজগ্রামের গামছাই বুঝতেন।
একটা সময় ছিল যখন বাঁকুড়ার এই রাজগ্রাম মুখরিত থাকত মাকুর শব্দে। গোটা গ্রাম জুড়ে তাঁত শিল্পীর সংখ্যা ছিল প্রায় হাজার দুই। তাঁতের কাপড়, গামছা বোনাই ছিল একমাত্র রুজি রোজগারের পথ। উৎপাদিত গামছা জেলার সর্বত্র চাহিদা মিটিয়ে পৌঁছে যেত কলকাতা সহ রাজ্যের সর্বত্র। শুধু বাংলাতেই নয়। এই হাতে বোনা গামছার চাহিদা ছিল ভিন রাজ্যেও। মেশিনে বোনা তাঁতের সাথে হাতে বোনা এই তাঁতের আকাশ পাতাল পার্থক্য হাতে নিলেই বোঝা যায়। সেই সময় বাঁকুড়ায় ঘুরতে এলেই মানুষজন অবশ্যই ঢুঁ মারতেন এই গ্রামে। সঙ্গে নিয়ে ফিরতেন হাতে বোনা গামছা ও শিল্পীদের একরাশ ভালোবাসা।
কিন্তু এখন সবটাই অতীত। আধুনিক কলাকৌশল, যন্ত্রচালিত তাঁতের দাপটে হাতে বোনা তাঁত প্রায় বিলুপ্ত। দৈনন্দিন জীবনে কিন্তু গামছার ব্যবহার এতটুকুও কমেনি বরং দিনে দিনে তা বেড়েছে। তবে সুতির শৌখিন হাতে বোনা গামছার বদলে জায়গা দখল করেছে পাওয়ারলুমে বোনা সস্তার গামছাগুলি। এমনিতেই এখন শৌখিনতার কদর করার মতো বাঙালির সংখ্যা তলানিতে। তাই স্বাভাবিকভাবেই বাংলার অন্যান্য ঐতিহ্যগুলির মতো তাঁত শিল্পও শেষের দিকে। দুর্ভাগ্যবশতঃ বাঁকুড়ার নতুন প্রজন্মও এ সম্পর্কে সেভাবে ওয়াকিবহল নয়। সঠিক প্রচার ও বিপণনের অভাবের সাথে সাথে পাওয়ারলুমের দাপট তো ছিলই। অগ্নিতে ঘৃতাহুতি পরেছে তাঁত বোনার সুতোর অত্যধিক দাম বাড়ায়।
একটা সময় যে গ্রাম মাকুর শব্দে মুখরিত থাকত। আজ সেখানে একশো জন তাঁতিও অবশিষ্ট নেই। আর্থিক সংকটে যে যার মতো আলাদা আলাদা জীবিকা বেছে নিয়েছেন। কিছুজন এখনো তাঁত বুনে চলেছেন বাপ দাদাদের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে। হতে পারে যন্ত্রচালিত পাওয়ারলুমের গামছার দাম বেশ কম। কিন্তু সেইসব গামছা শিল্পীদের হাতে বোনা গামছার গুণমানের ধারেকাছেও টিকবে না। বিলুপ্তপ্রায় এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকারি উদ্যোগের সাথে প্রয়োজন ব্যাপক হারে প্রচার ও সঠিক বিপণন। এই মুহূর্তে এই কাজে এগিয়ে এসেছে ‘বাংলার হস্তশিল্প’ পোর্টাল। তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছেন শিল্পীদের সাথে। তাদের উদ্যোগে শিল্পীদের বোনা গামছা খুব সহজেই পৌঁছে যাবে ক্রেতাদের কাছে। আশা রাখা যায় এমন ছোট বড় প্রচার ও উদ্যোগগুলির সাহায্যেই বাংলার ঐতিহ্যগুলো আবার প্রাণ ফিরে পাবে।
Discussion about this post