জনপ্রিয় সাহিত্যিক রাসকিন বন্ড এর ‘সুজানাস সেভেন হাসবেন্ডস’ সকলের যদিও বা না জানা থাকে, সেই বইয়ের অ্যাডাপ্টেসনে নির্মিত প্রিয়াঙ্কা চোপড়া অভিনীত ছবি সাত খুন মাফ হয়তো অনেকেরই মনে আছে। অনেকেই জানলে অবাক হবেন যে এই চরিত্রটি নিছক কাল্পনিক নয় বরং বাস্তব জগতে ডাচ আমলে চুঁচুড়ায় বসবাসকারী এক রহস্যময়ী নারীর জীবনের ওপর ভিত্তি করে গঠিত। যার জীবনের শেষ ঠাই হয়েছে এই অঞ্চলেই।
সম্রাট শের শাহের আমলে নির্মিত হয় যুগান্তকারি জি টি রোড যা তৎকালীন ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলকে চট্টগ্রাম থেকে ভায়া কলকাতা হয়ে সুদূর উত্তর পশ্চিমে আফগানিস্তানের সাথে যোগ করেছিল। এই জিটি রোডই একসময় উত্তর ভারতে ব্যবসা, বাণিজ্য ও সমৃদ্ধির সিল্ক রুট হয়ে উঠেছিল। এই রাস্তা ধরে কলকাতা থেকে ৩৫ কিলোমিটার উত্তরদিকে গেলে পৌছনো যায় চুঁচুড়া শহরে। একসময়ে বাংলায় এই ঐতিহাসিক আর্মেনিয়ান ও ডাচ বাণিজ্য নগরী এখন হুগলি জেলার সদর শহর হিসেবে অবস্থান করে। এর প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে ঔপনিবেশিক ইতিহাসের নানা অজানা ঘটনার পাণ্ডুলিপি।
এই জিটি রোড এর ঠিক পাশেই চুঁচুড়ার খাদিনা মোড় ও তালডাঙ্গা মোড়ের মাঝে অবস্থিত একটি রম্য ইউরোপীয় গথিক স্থাপত্যশৈলীতে গড়া সুজানা (মতান্তরে সুসান্না) আন্নামারিয়ার কবর। আঞ্চলিক অপভ্রংশে এই সৌধটি ‘ডাচ মন্দির’, ‘সাত বিবির গোর’ ইত্যাদি নামেও পরিচিত। এই ‘সাত বিবির গোর’ কথাটি অবশ্য এসেছে ‘সাত সাহেবের বিবির গোর’ থেকে কিন্তু কখন যে বিবির পাশে সাত সাহেবের উপস্থিতি ম্লান হয়ে অদৃশ্য হয়েছে, তা সঠিকভাবে বলা যায় না।
১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত এই সৌধটি মোট ৬০ বিঘা জমি নিয়ে গঠিত। বর্তমানে এটি ভারতীয় পুরাতত্ব বিভাগ দ্বারা সংরক্ষিত। এই চার দিক খোলা সৌধটি ইন্দো-ইউরোপিয়ান স্থাপত্য রীতির সংমিশ্রণে নির্মিত। চার দিক থেকে খাড়াই সিড়ি উঠে গিয়েছে সৌধটির গর্ভগৃহে। গর্ভগৃহের দরজার দুইদিকে দুটি করিনথিয়ান স্তম্ভ জোড়ায় জোড়ায় অবস্থান করছে। প্রাচীন গ্রীস দেশে জন্ম নেওয়া এই করিনথিনীয়ান স্তম্ভ পরে ইউরোপীয় স্থাপত্যের একটি মূল বৈশিষ্ট হিসেবে পর্যালোচিত হয়ে থাকে। এমনকি বাংলায় ইউরোপীয় ধাঁচে তৈরি স্থাপত্যগুলিতে এই স্তম্ভের ব্যবহার দেখা যায়। এমনকি শ্রীরামপুর কলেজের সামনের চারটি স্তম্ভ এই শৈলীর এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন বহন করে থাকে। এই স্মৃতিসৌধের মাথায় নিখাদ ইউরোপীয় ধাঁচের এক অর্ধগোলাকৃতি গম্বুজ ও তার মাথায় একটি চূড়া রয়েছে। সেই চূড়ার মাথায় স্মারকলিপি হিসেবে ডাচ ভাষায় খোদাই করে লেখা, “Susanna Anna Maria Yeats, nee Verkerk OBIT 12 May Anno 1809”
কিন্তু কে এই সুজানা (মতান্তরে সুসানা) আন্না মারিয়া? খুব আবছাভাবেই এনার অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায়। সাধারণত আঞ্চলিক লোককথায় বেশি প্রচলিত এই মহিলার অস্তিত্বকে একেবারেই নস্যাৎ করে দেওয়া যেত যদি না লন্ডনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ‘ইন্ডিয়া অফিস রেকর্ড’ এই ভদ্রমহিলার স্থাবর সম্পত্তির হিসেব থাকত। এই রহাস্যাবৃতা নারী চরিত্রের সম্পূর্ণ নাম ছিল ‘সুজানা আন্না মারিয়া ভারকার্ক’ যার জন্মসাল অজ্ঞাত। জনপ্রিয় মতামতের বিরুদ্ধে, সরকারী নথিপত্র অনুযায়ী কিন্তু তার দুটি বিবাহ, সাতটি নয়। তার প্রথম স্বামী ছিলেন পিটার ব্রুয়েস (Pieter Bruyes), বাংলার ডাচ ডিরেক্টর। তবে তিনি পরবর্তীকালে বিবাহ করেন একজন প্রতিপত্তিশালী ইংরেজ ব্যবসায়ী থমাস ইয়েটসকে (Thomas Yeats)।
আন্না মারিয়ার করে যাওয়া উইল অনুসারে, তাঁর কবর ‘আয়েশ বাগ’ অঞ্চলে তৈরি করা হয় যা জীবদ্দশায় ওনার প্রিয় বাগান ছিল। উইলে উল্লেখ ছিল যে, এই আয়েশ বাগ অঞ্চলের সমস্ত ইংরেজ ও ওলন্দাজ মানুষের কবরস্থান হিসেবে বিবেচ্য হবে। কিন্তু তার এই ইচ্ছাটি পূরণ করা যায়নি কারণ তার মৃত্যুর সমসাময়িক চুঁচুড়ায় ‘Dutch Cemetery’ বা ডাচ কবরস্থানের গোড়াপত্তন হয়। দাপ্তরিক দস্তাবেজ থেকে তার জীবদ্দশার কর্মকাণ্ড থেকে খুব একটা জানা না গেলেও প্রচলিত জনশ্রুতি এই যে উনি দানধ্যানে ব্রতী ছিলেন। তার উইল থেকে জানা যায় যে তিনি মোট চার হাজার টাকা রেখে গিয়েছিলেন তাঁর ও তাঁর দুই স্বামীর কবরসৌধ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য। বাকি বেঁচে যাওয়া অর্থ গরীব দুঃখীদের দান করার জন্য। সেই সময়ের নিরিখে অর্থের অঙ্ক বিবেচনা করলে দেখা যে যে চার হাজার টাকায় তখন দুটি অট্টালিকা নির্মাণ করে ফেলা যেত। স্থানীয় ঐতিহাসিকদের মতে এই কার্যের জন্য তিনি স্থানীয় ভারতীয়দের মধ্যে রাণীমা নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। এমনকি এখনো এই সৌধটি এলাকার বয়োঃজ্যেষ্ঠদের মধ্যে রাণী আন্না মারিয়ার কবর নামে পরিচিত।
এই মহিলার তিন জন সন্তান-সন্ততি ছিল বলে জানা যায় লন্ডনের ‘ইন্ডিয়া অফিস রেকর্ড’ থেকে। তাঁর দুই কন্যা সন্তান ছিল যাদের নাম ছিল সুজানা জকোবা (Susanna Jacoba), মারিয়া আনা ডে ব্রুয়েস (Maria Anna de Bruyes) এবং এক পুত্রসন্তান যার নাম ছিল লুই অদ্রিয়ান ডে ব্রুয়েস (Louis Adriaan de Brueys)। সেই রেকর্ড থেকে এও জানা যায় যে তাঁদের সম্পত্তির মধ্যে ছিল শহরের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে অবস্থিত একটি অট্টালিকা, ছয়টি ঘোড়া ও একটি টানাগাড়ি। London office of India Records -এ এটির উল্লেখ আছে এভাবে, “a house situated at Chitsura [sic.] at the South West side of the Comp. [Company] Factory”
তবে ইতিহাস ও যাবতীয় দস্তাবেজ যাযই বলুক। এই চরিত্রটি রহস্যময়ী হয়ে উঠেছে তাঁকে ঘিরে গড়ে ওঠা লোককথা নিয়ে, যার প্রমাণ না মিললেও সেগুলি জনশ্রুতি হিসেবে আজও এই অঞ্চলের লোকমুখে ঘুরপাক খায়। এমনটা দাবি করা হয় যে উনি সাত বার বিয়ে করেছিলেন ও প্রতিবার তার বিবাহিত স্বামী রহস্যজনকভাবে অন্তর্হিত হয়েছিল। এমনকি এর পেছনে খুনের তত্বও খাড়া করেন অনেকে। কিন্তু তাএই দাবীর স্বপক্ষে কোনও প্রমাণ আজ অবধি মেলেনি। এই চরিত্রহীন কলঙ্কের অধিকারিণী নারী তার কলঙ্কের আড়ালে দান-ধ্যান ও মমতাময়ী গুণ নিয়ে আজ পর্যন্ত আকৃষ্ট করে চলেন শিল্পী ও সাহিত্যকারদের। রাসকিন বন্ড প্রথমে এই সাত স্বামীর গল্প নিয়ে চার পাতার গল্প লিখলেও পরে তা এক পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস রূপে প্রকাশ পায়। এই উপন্যাস থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে পরিচালক বিশাল ভরদ্বাজ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেত্রী প্রিয়াঙ্কা চোপড়াকে মূল চরিত্র করে ফিল্ম বনালেন ‘সাত খুন মাফ (২০১১)’। তবে সমস্ত রহস্যময়তাকে সঙ্গী করে এখনও শুয়ে আছেন ‘রাণী’ আন্নামারিয়া তার বাগানে, এক ব্যস্ততম রাস্তার এক পাশে শান্তি ও শুভ্রতার মূর্ত প্রতীক হয়ে।
Discussion about this post