“অঞ্জনা নদীতীরে চন্দনী গাঁয়ে পোড়ো মন্দিরখানা গঞ্জের বাঁয়ে।” সহজ পাঠে রবি ঠাকুরের এই কবিতায় গ্রাম বাংলার একটি মিষ্টি চিত্র ফুটে উঠেছে। বাংলার গ্রাম গঞ্জে আনাচে কানাচে এমন কত ভাঙা মন্দির আছে যেখানে এখনও কোনও ‘অন্ধ কুঞ্জবিহারী’ হয় তো গান গেয়ে বেরায়। বাংলার মন্দির স্থাপত্যের কথা সারা ভারতবর্ষের প্রায় কারুরই অজানা নয়। তাদের মধ্যে কিছু মন্দিরের সাথে আমরা পরিচিত আবার কিছু এখনও অপরিচিতই রয়েছে। আজ জানবো দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জে অবস্থিত কিছু মন্দির স্থাপত্যের ইতিহাস।
১৭৭৫-৭৬ সাল নাগাদ কলকাতা এবং পূর্ববঙ্গের ও অসমের সাথে একটি যোগ সূত্র স্থাপন করার উদ্দেশ্যে মেজর টলি সাহেব একটি নালা খননের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি এই নালার ধারেই তৈরি করেন একটি গঞ্জ যা পরবর্তীকালে টলিগঞ্জ নামে পরিচিত হয়৷ এখানেই রয়েছে একটি বিখ্যাত রাধাকান্ত মন্দির। বজবজের বিখ্যাত বাওয়ালি জমিদার রামনাথ মন্ডল এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এই মন্দিরটিতে বাংলার বিখ্যাত নবরত্ন স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম নিদর্শন বহন করে। সারা মন্দিরের দেওয়াল জুড়ে রয়েছে ফুলের কারুকার্য। মন্দিরের সামনে রয়েছে একটি বড় নাটমন্দির। আবার এই মন্ডল পরিবারেরই দুটি রাজবাড়ি রয়েছে এখানে, যার মধ্যে একটি বড়ো ও অন্যটি তুলনামুলক ছোট।
এই ছোট রাজবাড়ির এক অংশে রয়েছে একটি বড় মন্দির চত্বর যা প্রতিষ্ঠা করেন বাওয়ালি বংশের সন্তান পেয়ারিলাল মন্ডল ও মণিমোহন মন্ডল। এই মন্দির চত্বরটির উঠোন সাদা কালো মার্বেল পাথর দিয়ে নির্মিত। ঢুকলেই প্রথমে চোখে পড়বে একটি নবরত্ন ও দুটি পঞ্চরত্ন মন্দির এবং তিনদিক ঘেরা ১২ টি শিব মন্দির। নবরত্ন মন্দিরটিতে গোপাল জিউ ও শ্যামসুন্দরের মন্দির পূজিত হয়৷ বাকি মন্দিরগুলিতে শিবের নানা রূপের পুজো হয়৷ বড় রাজবাড়িটির ভেতরেও রয়েছে দুটি মন্দির চত্বর। যার মধ্যে একটি মন্দির চত্বরে আটচালার নিদর্শন দেখা যায় এবং অন্য চত্বরটি তৈরি মোট ১২ টি মন্দির নিয়ে। এখানের রাস উৎসব খুবই বিখ্যাত যা জাঁকজমকভাবেই পালিত হয়৷
এই ভগ্নপ্রায় মন্দিরগুলির দেওয়ালের আনাচে কানাচে কান পাতলে আজও শোনা যাবে বাংলার কত লুকিয়ে থাকা ইতিহাস। কত ঐতিহ্য বাংলার প্রত্যেক গলির আঁকেবাঁকে এভাবেই আজও মাথা সোজা করে দাঁড়িয়ে। গঞ্জের বাঁয়ের এই পোড়া মন্দিরগুলিকে দেখলে সময় যেন থেমে যায়। সময় আমাদের নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয় বাংলার পুরনো সমস্ত ছবির সামনে।
Discussion about this post