সারেঙ্গী লোক যন্ত্ররূপে অতি প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত ও জনপ্রিয় একটি বাদ্যযন্ত্র। কণ্ঠসঙ্গীতের বা উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের গায়কের সাথে এই যন্ত্রটি সহযোগী যন্ত্র হিসাবে অতি সুপরিচিত। প্রায় সপ্তদশ শতক থেকে সারেঙ্গী রাগ সঙ্গীতের যন্ত্ররূপে প্রচলন লাভ করে। ভগবান বিষ্ণুকে প্রণাম করার ভঙ্গি থেকে সারেঙ্গী নামটি পেয়েছে। কিছু সংগীতজ্ঞের মতে সরঙ্গি শব্দটি ‘সেহ’ (পার্সি ভাষায় তিনের সমতুল্য) এবং ‘রাঙ্গি’ (বর্ণের পার্সিয়ান সমতুল্য)এই দুটি শব্দের সংমিশ্রণে সেহ-রাঙ্গি শব্দটির উৎপত্তি। সেহ-রাঙ্গি শব্দটি তিনটি সুরকে উপস্থাপন করে। তবে সর্বাধিক প্রচলিত লোক ব্যুৎপত্তিটি ‘সল রেং’ (একশো রঙ) থেকে উদ্ভূত হয়েছে যা এর কৌতূক সঙ্গীতের অনেকগুলি শৈলীর সাথে তার অভিযোজন যোগ্যতা, তার নমনীয় সুর, টোনাল রঙ এবং সংবেদনশীল সংশ্লেষের একটি বৃহৎ প্যালেট উৎপাদন করার ক্ষমতা বোঝায়।
স্থানভেদে সারেঙ্গীর আকারেও পার্থক্য লক্ষ করা যায়। বিশ শতকের প্রথম দিকে সারেঙ্গী একক রাগ সঙ্গীত যন্ত্ররূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। অবশ্য কণ্ঠ সঙ্গীতানুগামী যন্ত্ররূপেই বজায় থাকে সারেঙ্গীর মুখ্য ভূমিকা। প্রায় দুই ফুট লম্বা একখণ্ড খোদাই করা কাঠে সারেঙ্গীর অবয়র নির্মিত হয়। কাঠ খণ্ডের নীচের দিকটা খোলের মতো খোদাই করা হয়। খোলটি চামড়ায় ছাওয়া হয়ে থাকে। খোলের ছাউনির মাঝখানে বসানো হয় একটি সওয়ারী। ভারতীয় বাদ্য ও তার বিভিন্ন প্রকারের মধ্যে সারঙ্গী একটি ততবাদ্য যন্ত্র হিসাবে পরিচিত নাম। ততবাদ্য অর্থাৎ যেসব সঙ্গীত যন্ত্রে তারে আঘাত করে স্বর উৎপাদন করা হয় তাকেই ততবাদ্য বলা হয়। যেমন- বীণা, রবার, তানপুরা, সেতারা, সারেঙ্গী, এসরাজ, বেহালা, একতারা, দোতারা ইত্যাদি এই ততবাদ্যশ্রেণির যন্ত্র। ততবাদ্য তিন প্রকার। যথা : ক. ততবাদ্য যেসব যন্ত্রের তারে আঙুল দিয়ে আঘাত করে স্বর উৎপন্ন হয়। যেমন- বীণা, সেতারা, সরেঙ্গী, তানপুরা ইত্যাদি। খ. যেসব যন্ত্রের তারে বা হাতে গজ বা ছড় টেনে স্বর উৎপন্ন করা হয় তাকে বিতত বাদ্যও বলা হয়। যেমন- এসরাজ, বেহালা, সারেঙ্গী, দিলরুবা। গ. কাঠখণ্ডের আঘাতে স্বর উৎপন্ন হয়- এমন যন্ত্র। যেমন- পিয়ানো।
সাধারণত কাঠখণ্ডের ওপরের প্রান্তে দুইদিকে থাকে দুই দুই করে চারটি চাবি বা কান। চারটি কানে বাঁধা সারেঙ্গীর প্রধান চারটি তার সওয়ারীর ছিদ্রের ভিতর দিয়ে গিয়ে খোলের নিম্নপ্রান্তে আবদ্ধ হয়। এ ছাড়াও সারেঙ্গীতে পিতলের এই তারগুলোও সওয়ারীর নীচের দিককার সারির ছিদ্র দিয়ে গিয়ে প্রান্তদেশে আবদ্ধ হয়। সারেঙ্গী মূলত ছড় দিয়ে সাজানো হয়। দিল্লি ঘরানা ও করানসী ঘরানা হলো দুটি প্রধান সারেঙ্গী ঘরানা।
মধ্যযুগে সুফি সাধকদের সাধন-ভজনে এই বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার ছিল। রাজসভাতেও বিনোদনমূলক নৃত্য-গীত-বাদ্যের ব্যবস্থা ছিল এবং তাতে অনেক বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হত। বিশেষত ‘রাগতালনামা’য় এর বর্ণনা আছে। ইংরেজদের আগমনের পরে এদেশে পাশ্চাত্য সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। হারমোনিয়াম, বেহালা, গিটার, ফ্লুট, বিউগল, ব্যাঞ্জো ইত্যাদি পাশ্চাত্যের বাদ্যযন্ত্র। শহর-গ্রাম সর্বত্র হারমোনিয়াম এখন একটি সাধারণ বাদ্যযন্ত্র এবং এ দিয়েই সঙ্গীত শিক্ষার হাতেখড়ি হয়। সারেঙ্গী অনুগত যন্ত্র হলেও বর্তমানে স্বতন্ত্র যন্ত্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে এর বিশেষ ব্যবহার আছে। অর্ধচন্দ্রাকৃতি ছড় দিয়ে যন্ত্রটি বাজাতে হয়। সারেঙ্গীর আওয়াজ মিষ্টি। গজল, খেয়াল, টপ্পা, কাওয়ালি, ঠুংরি ইত্যাদি গানের সঙ্গে সারেঙ্গী বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়। মন্দ্রনাদ মন্দ্রস্বরের একটি অনুগতসিদ্ধ বাদ্যযন্ত্র। এর উদ্ভাবক ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ। সুররবাব বাজাবার নিয়ম সুর শৃঙ্গারের মতো।
সারেঙ্গি সারঙ্গদেবী বীণার আধুনিক রূপ। এটি অত্যন্ত শ্রুতিমনোহর এবং সহযোগী যন্ত্র হিসেবে অতুলনীয়। মানুষের কণ্ঠের অনুরূপ অনুভূতিপ্রবণ স্বর-প্রক্ষেপণ এ যন্ত্রের মতো অন্য কোনো যন্ত্রে এত সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে না। তাই কণ্ঠ সঙ্গীতের সঙ্গে সবচেয়ে উপযোগী যন্ত্র হিসেবে সারেঙ্গি সমাদৃত। ঠুংরি, দাদরা, কাজরী, চৈতী, হোলী ইত্যাদি শৈলীর শান্ত, করুণ ও শৃঙ্গার রসাত্মক প্রেমবিরহের অনুভূতি সারেঙ্গিতে অসাধারণভাবে ফুটে ওঠে। সারেঙ্গি একক বাদনের জন্যও বিশেষ উপযোগী। পন্ডিত বুন্দু খাঁ, আলী বক্স (দিল্লি), সাবিত আলি (গোয়ালিয়র), হুসেন বক্স (লক্ষ্ণৌ), গুলাম সাবির (দিল্লি), গোপাল মিশ্র, মেহেদি হোসেন খাঁ প্রমুখ সঙ্গীতজ্ঞ সারেঙ্গির এককবাদন বা সহযোগী বাদনের জন্য বিখ্যাত।
দেশভাগের আগে বাংলাদেশে সারেঙ্গী বাদকদের ঢাকায় বসবাসের কথা জানা যায়। ওস্তাদ সগীরউদ্দিন খাঁ বাংলাদেশেই ছিলেন এবং সম্প্রতি পরলোক গমন করেন। বর্তমানে দিলীপ কুমার রায় বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে সারেঙ্গি বাজান। প্রসঙ্গত রাম নারায়ণও একজন বিখ্যাত ভারতীয় সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। সচরাচর তাকে ‘পন্ডিত রাম নারায়ণ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে সারেঙ্গী ব্যবহারে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রয়েছে। তিনিই প্রথম আন্তর্জাতিক ভাবে প্রখ্যাত সারেঙ্গী বাদক। সময়ের সাথে সাথে এর ব্যবহার কমলেও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তার কদর কমেনি। সে নিজ মর্যাদায় আজও বেজে চলেছে।
Discussion about this post