ব্যরি লেভিনসনের ‘রেইন ম্যান’ সিনেমার কথা মনে আছে? গল্পের নায়ক রেমন্ড, রেস্টুরেন্টে ওয়েট্রেসের পোশাকে লেখা নাম দেখেই, মনে করে ফেলেছিল টেলিফোন ডাইরেক্টরিতে থাকা মেয়েটির ফোন নাম্বার। হাত না লাগিয়েই , কেমন গুনে ফেলেছিল মেঝেতে পড়ে থাকা টুথপিকের সংখ্যা! ডাস্টিন হফম্যান অভিনীত এই চরিত্রের নেপথ্যে কিন্তু রয়েছে একজন প্রকৃত রক্ত মাংসের মানুষ।
লরেন্স কিম পিক। জন্ম ১৯৫১ সালের ১১ই নভেম্বের, আমেরিকার সল্ট লেক সিটিতে। জন্ম থেকেই তাঁর মাথার আকার ছিল শরীরের বাকি অংশের তুলনায় অনেকটাই বড়। সেই সময় ডাক্তাররা মনে করেন, কিম অটিজমে আক্রান্ত। পরে জানা যায় অটিজম নয় এফজি সিনড্রোমে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। মস্তিষ্কের দুটি খন্ডের মাঝে যোগাযোগ স্থাপন করে যে সকল স্নায়ু, কিমের ক্ষেত্রে সেই স্নায়ুর সংখ্যা ছিল অনেক কম।যার ফলে শৈশবে শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটেছে অন্যান্য শিশুদের তুলনায় অনেক ধীর গতিতে। ডাক্তারেরা আগেই হাত উঠিয়ে নিয়েছিলেন,এই শিশু কোনোদিন হাঁটতে বা কথা বলতে পারবেনা। কিন্তু ওই যে, “হাল ছেড়ো না বন্ধু!” বাবা,মা এর চেষ্টায় চার বছর বয়সে কিম হাঁটতে শেখেন। তবে মগজ সেই এক বছর বয়স থেকেই অসাধারণ ক্ষুরধার। মা,বাবা যে গল্প পড়ে শোনাতেন মনে রেখে দিতেন তাই। জামার বোতাম লাগাতে হিমশিম খেলেও তাঁর ছিল ফটোগ্রাফিক মেমোরি! একবার যা দেখতেন পড়তেন, হুবহু তা মনে রাখতেন চিরকালের জন্য। বইয়ের প্রতি ছিল আলাদাই এক নেশা। ১২০০০ টি বই এর প্রতিটি পাতা ছিল যেন একেবারে তাঁর ঠোঁটস্থ। পড়ে ফেলতেন বই এর দুটি পাতা একসঙ্গে। এখানেই তো বিস্ময়!
এক ঘণ্টারও কম সময়ে শেষ করে দিতেন এক একটি বই। আর যে বই পড়া হয়ে যেত, বইয়ের তাকে সেটি উল্টো করে রাখার অভ্যেস ছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। ক্যালেন্ডার না দেখেই দিন-তারিখের পাকা হিসেব করা কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার মাত্র। একবার গান শুনে তার সুর মনে রেখে দিতেন মগজে, তুলে নিতেন পিয়ানোয়। শুধু পড়ার বই কিংবা গানের সুর নয়,মানচিত্রের বইগুলোও যেন তাঁর সাথে কথা বলতো। একবার মানচিত্র দেখলেই বলে দিতে পারতেন কোন রাস্তা কোথায় গিয়ে বাঁক নেবে। গুগল ম্যাপস এর জমানায়, এসব শুনলে তো একটু অবাক লাগবেই। সাধারণত ,স্যভ্যন্ট সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিরা পারদর্শী হয় একটি অথবা দুটি বিষয়ে। তবে কিম ছিলেন ১৫টি বিষয়ে আশ্চর্য রকমের পারদর্শী। ব্যরি ম্যরোউ, কিম পিককে কেন্দ্র করেই লিখেছিলেন ‘রেইন ম্যান’ সিনেমার চিত্রনাট্য। ১৯৮৮ সালে সিনেমাটি অস্কার পায় চারটি বিভাগে। ব্যরি এই অস্কারের টাকা দিয়ে চালু করেন ‘পিক অ্যাওয়ার্ড’।
২০০৯ সালে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হন তিনি। ব্যস, ওখানেই থেমে যায় কিমে পিকের জীবন দৌড়। মাত্র ৫৮ বছর বয়সে মারা যান তিনি। কিন্তু ,”বাবুমশাই জিন্দেগি ব্যরি হোনি চাহিয়ে ,লম্বি নেহি।” যাকে ডাক্তার বলেছিল কোনদিনও হাঁটতে বা কথা বলতেই পারবেনা, সেই কিম পিক এক বিস্ময় মানব বাকি দুনিয়ার কাছে। এই জন্যই পৃথিবীটা বুঝি অনেক অনেক বড়ো, আমার আপনার কল্পনারও বাইরে!
Discussion about this post