দুপুরের পর যাদবপুর কফি হাউসে ঢুকলেই জানলার ধারের টেবিলটিতে একজন মানুষকে দেখা যাবে। ষাটোর্ধ্ব মানুষটি বসে আছেন ডায়রি, পেন হাতে। তাঁর চোখ জানলার বাইরে অনেক দূরে কোথাও। মানুষটি হলেন জয়দেব চক্রবর্তী। যাদবপুর কফি হাউসে নিয়মিত আসেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতক। জীবনযাপন করছেন টিউশন পড়িয়ে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের একজন প্রত্যক্ষ সৈনিক। মিছিলে হেঁটেছেন, স্লোগান দিয়েছেন, পালিয়ে বেড়িয়েছেন পরিবারের সঙ্গে, গুলি পর্যন্ত খেয়েছেন। তবে তাঁর মূল পরিচয় তিনি একজন কবি ও গদ্যকার।

মজার বিষয় সম্ভবত বাংলায় এই মুহূর্তে জয়দেব চক্রবর্তীই একমাত্র কবি, যিনি জীবনে তিনটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছেন। শুধু বাংলায় কেন, গোটা ভারতবর্ষেই এমন মানুষের উপস্থিতি বিরল। পাকিস্তান অধিকৃত পূর্ব বাংলায় ৯ বছর বয়স পর্যন্ত স্কুল ছাত্র হিসেবে জয়দেব গেয়েছেন ‘কওয়ামি তারানা’। “পাক সার জমিন সাদ বাদ, কিশওয়ারে হাসিন সাদ বাদ, তু নিশানে আজমে আলী শান, আরজে পাকিস্তান” গানটি ১৯৫৬ সালে গোলাম মোস্তফা বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। সুর দিয়েছিলেন নাজির আহমেদ। সেই গানটি ছিল এমন, “প্রাচ্য প্রতীচ্যের মিলন গাহি/ঝান্ডা জাগে যে আজাদ…/পাকিস্তান জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।”

স্বাধীনতার পরে ১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে প্রথম গাওয়া হয় রবীন্দ্রনাথের “আমার সোনার বাংলা”। ১০ বছরের বালক জয়দেব তখন গেয়েছেন এই গান। পাকিস্তান সরকার তাদের পরাজয় স্বীকারের দলিল যেদিন সই করেছিল, সেদিনের স্মৃতিচারণ করেছেন তিনি তাঁর ‘গহন কালের আয়ু’ গ্রন্থে, “…কোথায় কোথায় ঘুরেছে সেসব আলোচনা করতে করতে ছায়াপথে হাঁটছিল সবাই। আগে-পিছে প্রচুর লোকজন। সবার মুখেই উচ্ছ্বাসের বার্তা। এসময় সামনে থেকে কেউ যেন গেয়ে উঠল “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।” সে রাতের ওই মিলিত কণ্ঠে গাওয়া গান যেন আমাদের প্রাণের সংগীত হিসেবে গাওয়া হল।”

বিজয়ের পরেও জয়দেব ও তাঁর পরিবার নিজেদের ভিটেতে ফিরতে পারেননি। বিভিন্ন ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে তাঁদের চলে আসতে হয়েছে ভারতে, কলকাতায়। মুক্তিযুদ্ধের কিছুকাল পর থেকে তিনি তাই ভারতের নাগরিক। সেই সূত্রে অবধারিতভাবেই তাঁকে গাইতে হয়েছে ‘জনগণমন অধিনায়ক’। তাঁর বাবা গত হয়েছেন কয়েক বছর আগে। মৃত্যুর পূর্বে অসুস্থ অচেতন অবস্থায় তিনি বলছিলেন, “চলো চলো দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, আমরা ফিরে যাবো।” জয়দেবের মনে পড়ে চল্লিশ বছর আগের এক রাত। বিজয়ের পরেও রাত্রিবেলা বাড়ি ফিরে বাবা বলেছিলেন, “চলো, এবার আমরা ফিরে যাব। দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে।” জয়দেব চক্রবর্তীর আপামর সাহিত্য রচনার মধ্যে বারবার উঠে আসে দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ, শিকড় ছেঁড়া মানুষের কথা। এই আবহেই আজও তাঁর জীবন ও কবিতার যাত্রা চলেছে।
Discussion about this post