বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিশ্ব-বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মোট চারবার সাক্ষাৎ ঘটে। রবীন্দ্রনাথ ১৯২১ সালে প্রথম জার্মানী যান। যদিও সেবার আইনস্টাইনের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়ে ওঠেনি। এরপর তিনি দ্বিতীয় সফর করেন ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে। সেবার ১৪ই সেপ্টেম্বরের সকালে জার্মানীর সাংস্কৃতিক মন্ত্রী বেকার রবীন্দ্রনাথের সম্মানে একটি চা-পার্টির আয়োজন করেন। সেই পার্টিতে জার্মানির বিভিন্ন বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিকদের মধ্যে আমন্ত্রিত ছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইনও। তখনই আইনস্টাইনের সঙ্গে কবির প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে রবীন্দ্রনাথ আবার জার্মানি যান। ১৪ জুলাই, কাপুথে অবস্থিত আইনস্টাইনের নিজ বাসভবন ‘আইনস্টাইন ভিলা’য় তাঁদের মধ্যে দ্বিতীয় বারের জন্য সাক্ষাৎ ঘটে। স্বভাবতই দুজন বিখ্যাত জ্ঞানী মানুষ যখন এক সঙ্গে আছেন, তখন গভীর আলোচনা তো হবেই। তবে তাঁদের আলোচনার বিষয় শুধু সাহিত্য কিংবা বিজ্ঞান ছিল না। বরং তাঁরা আলোচনা করেন মানব ইতিহাসের গভীর ও জটিল কিছু বিষয় নিয়ে। এছাড়াও তাঁদের মধ্যে তৎকালীন বিশ্ব-পরিস্থিতি, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং মানব চেতনা নিয়েও আলোচনা হয়। কবি ও বিজ্ঞানীর সেদিনের সেই সুদীর্ঘ আলোচনার সাক্ষী ছিলেন কবি অমিয় চক্রবর্তী। তাঁদের দুজনের সেই আলোচনা ছিল ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতই।
কথোপকথনের শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ বলেন যে আইনস্টইন তাঁর গণিত দিয়েই স্থান-কাল-পাত্রের ব্যাখ্যা খুঁজতে ব্যস্ত। সেই প্রসঙ্গেই এরপর তাঁরা মানব সত্ত্বা ও মহাবিশ্বের বিভিন্ন তত্ত্ব নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা করেন। স্বর্গ থেকে পৃথিবী, বিজ্ঞান থেকে পিথাগোরাসের জ্যামিতি অথবা বাস্তব চিন্তাভাবনা থেকে মানব ধর্ম, তাঁদের আলোচনায় বাদ যায়নি প্রায় কিছুই। বিজ্ঞানের সঙ্গে মানবিকতার ধর্ম মিলেই যে পৃথিবীর পরম সত্য, একথাও আলোচনার নির্যাস হিসেবে বেরিয়ে আসে। বিশ্ব, মন ও আমাদের ব্যক্তি মনের সংঘাতই হল সত্যের ক্ষেত্রে সবথেকে বড় দ্বন্দ্ব। তাই বিজ্ঞান, দর্শন ও আমাদের মূল্যবোধের মাধ্যমে এই দুইয়ের মধ্যে মিল ঘটানোর চেষ্টা চলছে, একথাও উঠে আসে তাঁদের কথাবার্তার মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথ এও বলেন, তাঁর কাছে ধর্ম মানে নিজের চেতনায় মানব মন ও বিশ্ব মনের সংমিশ্রণ ঘটানোকেই বোঝেন তিনি।
১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের মধ্যে তৃতীয়বার সাক্ষাৎ ঘটে। এরপর সেই বছরেরই ১৫ ডিসেম্বর আমেরিকার নিউ ইয়র্কে তাঁদের মধ্যে চতুর্থবার এবং শেষবারের মত দেখা হয়। সে বছর রবীন্দ্রনাথ নিউ ইয়র্কে এক চিত্রশিল্পীর বাড়িতে তাঁর অতিথি হিসাবে ছিলেন। আইনস্টাইন সেখানেই রবি ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তাঁদের দুজনের মধ্যে এই চারবারের সাক্ষাৎ ছাড়াও বহুবার চিঠি-পত্র বিনিময় হয়েছিল। আইনস্টাইনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এই সাক্ষাৎকারগুলিও একসঙ্গে বা আলাদা ভাবেই অনেক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথ সংলাপের সংক্ষিপ্ত বাংলা অনুবাদ ১৯৩১ সালে ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় বেরিয়েছিল। তবে যতদূর জানা যায় ‘দ্য মডার্ণ রিভিউ’-তে প্রকাশিত তাঁদের সাক্ষাৎকার দেখে আইনস্টাইন কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। ২০০১ সালে ‘দ্য কেনিওন রিভিউ’, দিমিত্রি মারিয়ানফ এবং অমিয় চক্রবর্তীর সমন্বিত নোট, শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্র ভবনে সংরক্ষিত আর্কাইভস ভিত্তি করে সমন্বিত কথোপকথনের ভাষ্য প্রকাশ করেছে। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথকে নিজের হাতে লেখা আইনস্টাইনের জার্মান ভাষার দু’টি চিঠি শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবন সংগ্রহশালায় আজও সংরক্ষিত রয়েছে।
Discussion about this post