পুরনো কলকাতার দুর্গা পুজোর আনন্দ আর রীতিনীতি কোনো এক বিশেষ স্বাদে পুরোপুরি প্রতিফলিত হত। আর সেই স্বাদের মধ্যে সবচেয়ে আলাদা ও স্মরণীয় ছিল বিজয়া-স্পেশাল নারিকেল ছাবা। সাদা ও মসৃণ নারকেল দিয়ে বানানো এই মিষ্টি ছিল শুধু রসিকতা নয়, বরং প্রণামী দেওয়ার বিশেষ রেওয়াজের প্রতীক। ষষ্ঠীর ভোর থেকে মহাষ্টমীর সন্ধ্যা পর্যন্ত দুর্গা পুজোর আনন্দ, ধুনো-দ্বীপ আর ঢুলির তালে-তালে নাচের মধ্যেও এই নারিকেল ছাবার উপস্থিতি যেন উৎসবের প্রাণসংগীত হয়ে উঠত। প্রণামী হিসেবে দেওয়া এই মিষ্টি শিশুরা হোক বা বৃদ্ধ, সকলের মুখে হাসি ফোটাতো। আর তা ছিল তখনকার কোলাকুলির অন্যতম আকর্ষণ।

সেই সময়ের প্রতিমার সাজ-সজ্জা ও বাহন নিয়ে বিভিন্ন প্রথা দেখা যেত। শাক্তদের বাড়িতে সিংহের আকার, বৈষ্ণবদের বাড়িতে অশ্বমুখ সিংহ – এই পার্থক্য ছিল। কিন্তু সব জায়গাতেই মাটির গহনাই ব্যবহার হত। ডাকের সাজের নামকরণও মূলত এই মাটির গহনাকে প্রতিমার সঙ্গে জোড়ার পদ্ধতি থেকে এসেছে। প্রযুক্তি ও পরিবহনের উন্নতি আসার পর ধীরে ধীরে প্রতিমার সাজে বৈচিত্র্য ও নতুনত্ব এসেছে। কিন্তু নারিকেল ছাবার মতো ক্লাসিক অভিজ্ঞতা এখনও সেই সময়ের মাধুর্য বহন করে।
দুর্গা পুজোর ভক্তি ও আনন্দের সঙ্গে শিশুদের উৎসবও ছিল আলাদা। নীল রং মাখানো তাঁতের কাপড় পরা, ঢুলির তালে নাচ, খেলনা সিংহকে বলি দেওয়া ― সবই ছোটদের জন্য উৎসবের আকর্ষণ। এই আনন্দের সঙ্গে নারিকেল ছাবা মিষ্টিও শিশুদের কাছে ছিল বিশেষ, কারণ বিজয়ার দিন প্রণামী হিসেবে শুধু এই মিষ্টি দেওয়া হত। বড়রা যেমন নিজেদের মধ্যে কোলাকুলি করতেন, তেমনি শিশুরাও নিজেদের খুশিতে মগ্ন থাকতেন। আর নারিকেল ছাবা ছিল সেই আনন্দের অন্যতম মাধ্যম।
পাঠ্য ও স্মৃতিচারণ থেকে স্পষ্ট হয়, সেদিনের কলকাতার দুর্গা পুজো ছিল সম্পূর্ণ পারিবারিক ও সামাজিক সমন্বয়ের উৎসব। খাবারের তালিকা, পুজোর আয়োজন সবই জন্মগত বংশ, শাস্ত্রবিধি ও লোকাচারের মধ্যে ছিল। ব্রাহ্মণ বাড়িতে ভাত-তরকারি, শাক্ত পরিবারে মাছ বা শাকের পদ—সবই সাদামাটা হলেও সকলকে সমানভাবে খাওয়ানো হত। আর বিজয়ার দিনে নারিকেল ছাবা মিষ্টি প্রণামী হয়ে সেই সমন্বয় ও ভক্তির প্রতীক হয়েই ছিল। আজকের কলকাতার উজ্জ্বল দুর্গা পুজোতে রীতি কিছুটা বদলেছে। কিন্তু নারিকেল ছাবার মতো ক্লাসিক স্মৃতি এখনও মানুষকে অতীতের আনন্দের সাথে যুক্ত করে রাখে।
Discussion about this post