সিন্ধুসভ্যতা থেকে বৈদিক সভ্যতার মধ্যবর্তী কয়েকশো বছরের ইতিহাস যেমন নীরব, বাংলার ইতিহাসেও দ্বাদশ শতাব্দীর দেউল স্থাপত্য থেকে ষোড়শ শতাব্দীর চালা স্থাপত্যে বিবর্তনের সময়টা অন্ধকারেই রয়ে গেছে। ফলে, তুর্কি আক্রমনের জন্য হোক কিম্বা কালাপাহাড়ের রোষেই হোক, কোন এক অজ্ঞাত কারণে বাংলায় ত্রয়োদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত, এই তিনশো বছরের ভিতরে বানানো আর একটি মন্দিরও অক্ষত নেই। যেমন অবশিষ্ট নেই বীরভূমের ইটান্ডা গ্রামের প্রাচীন টেরাকোটা মন্দিরগুলি। যেটুকু টিকে আছে কোনোমতে, সেগুলিই টেরাকোটাপ্রেমী, ইতিহাসপ্রেমী এবং প্রাচীন স্থাপত্যের পুজারী মানুষদের জন্য প্রায় রত্নভান্ডার।
বোলপুর থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে, বীরভূম জেলার সীমানার প্রত্যন্ত গ্রাম হল ইটান্ডা। এই নামটি সম্ভবত ব্রিটিশ ‘East India’ থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়। প্রায় দুশো বছর আগে এই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যেত অজয়। সেইসময় এই অঞ্চল বিখ্যাত ছিল নীল চাষ আর ব্যবসার জন্য। উনিশ শতকের মোট ১৮ টা জনপদ নিয়ে তৈরি হয়েছিল এই বর্ধিষ্ণু গ্রাম। বর্তমানে নদী সরে গেছে অনেকখানি। গ্রামের পুরনো জৌলুসও আর নেই। তবে দুই থেকে তিনটি শিব মন্দির রয়েছে। প্রতিটি মন্দিরের আলাদা আলাদা গল্প আছে। প্রতিটি মন্দির তৈরির পদ্ধতিও ভিন্ন। সেগুলিই এই গ্রামের বিশেষত্ব।
উর্বর পলি মাটি। পূর্বে অজয় নদ বইত ইটান্ডার গা বেয়ে। নীল, গালা, সুতি বস্ত্র, হাড়ের চিরুনি, মশলাপাতি, পিতল কাঁসার তৈজস পত্র প্রভৃতি মালপত্র ওঠানামা হত, বাণিজ্য হত জলপথে। ইটাণ্ডা ছিল জমজমাট বাণিজ্য কেন্দ্র। তখনকার বিখ্যাত জায়গা সুপুর, সুরুল, ইটাণ্ডা। আজ আর সেই ইটাণ্ডা নেই। কিন্তু, ১২২২ এবং ১২৩৫ সালে নির্মিত দুটি শিবমন্দিরের খোঁজ পাওয়া যায়। প্রায় সমসময়েই তৈরি, জোড়বাংলা রীতির কালীমন্দিরের টেরাকোটা অলংকরণও অসাধারণ। অতি চমৎকার কলমকারির (স্টাকো) কাজ দেওয়ালে। কিন্তু উপরের ছাদ ভেঙে পড়ছে। সংস্কার করা হয়না। এছাড়া রয়েছে, বাউরি পাড়ায় একটি ছোট চালা রীতির শিবমন্দির। বিশাল অশ্বত্থ তলে সম্ভবত প্রাচীন কোন নির্মানের উপরে তৈরি হয়েছিল মন্দিরটি। এখন সেটি অশ্বত্থের বাঁধনে বাঁধা, দেখা যায় না বললেই চলে।
বীরভূমে বর্গীর আক্রমণ হত ঘনঘন। সিউড়ির কাছে কেন্দুয়াডাঙ্গায় ছিল তাদের প্রধান ঘাঁটি। ইটান্ডাও তাদের লুঠতরাজ থেকে রক্ষা পায়নি। ইটান্ডার মানুষেরা বারবার বর্গী আক্রমণ প্রতিরোধ করলেও শেষবার ইটান্ডা তার হৃতগৌরব আর ফিরে পায়নি। অনেক ব্যবসায়ীরা চলে গিয়েছিলেন। মন্দিরগুলিও ভগ্নপ্রায় অবস্থায় রয়েছে। আরও ভেঙে পড়ছে। শেষ হয়ে যাচ্ছে প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যগুলি।
Discussion about this post