ক্রিং ক্রিং ক্রিং… টেলিফোনটা বাজতেই একছুটে গিয়ে ভিড় করতাম তার সামনে। “কে জানে কে আবার ফোন করল! বড়পিসি নয় তো? নাকি দূর্গাপুরের মামা? নৈহাটির দিদাও হতে পারে। উফফ কত্তদিন পর কথা হবে! আমার কথা জিজ্ঞেস করবে তো?” এসব নানা জিজ্ঞাসা ভিড় করে আসত আমাদের মনে। তার দোসর ছিল একজনই। ছোট্টবেলার সেই গাবদা কালো টেলিফোন। একসময় যার ‘ক্রিং ক্রিং’ আওয়াজে বুঁদ হয়ে থাকত সারা কলকাতা। আর এই টেলিফোনের সঙ্গেই জড়িয়ে ছিল আমার ছেলেবেলার হাজারও স্মৃতি, নস্টালজিয়া…
গ্রাহাম বেল ১৮৭৬ সালে আবিষ্কার করেন এই টেলিফোন। ভারতে তখন জাঁকিয়ে বসেছে টেলিগ্রাফ। তবে টেলিফোন আবিষ্কারের পরই এর সাফল্য দেখে ১৮৭৯ সালে কলকাতায় টেলিফোন আনার আর্জি রাখেন ‘দ্য অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কম্পানি লিমিটেড’। কিন্তু টেলিগ্রাফের বাজার পড়ে যেতে পারে এই দুঃশ্চিন্তায় তখন ছাড়পত্র মেলেনি। সময় বদলায় ১৮৮১ সালে। ভারতে টেলিফোন আনার অনুমতি পায় ‘দ্য ওরিয়েন্টাল টেলিফোন কোম্পানি লিমিটেড’। বম্বে (বর্তমান মুম্বাই), মাদ্রাজ (বর্তমান চেন্নাই) এবং কলকাতায় প্রথম স্থাপিত হয় টেলিফোন এক্সচেঞ্জ।
সেসময় ভারতে টেলিফোনের গ্রাহক ছিলেন মাত্র পঞ্চাশ জন। মাত্র একজনই ছিলেন বাঙালি, ‘শিবনাথ দাঁ এন্ড কোং’-এর তৎকালীন মালিকানা ছিল যাঁর হাতে সেই তিনি। তবে ব্যক্তিগতভাবে প্রথম বাঙালি যিনি টেলিফোন ব্যবহার করেন তিনি ছিলেন সাগরলাল দত্ত নামে জনৈক এক ব্যক্তি। এরপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে টেলিফোনের প্রচলন। রবিঠাকুরের শান্তিনিকেতনেও পৌঁছে যায় সে। শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথ নাকি গান গেয়ে শান্তিনিকেতনে প্রথম টেলিফোন ব্যবস্থার সূচনা করেছিলেন।
এরপর বহু বছর আমাদের রোজকার জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল সেই টেলিফোন। এই যন্ত্রটি ঘিরে লেখা হয়েছে কত গান, কবিতা, গল্প। কত মানুষের নতুন প্রেমের সূচনাও হয়েছে টেলিফোনের রং নাম্বারের মাধ্যমে। আবার পুরনো চিঠিপত্রের প্রেম এসে নতুন রূপে আলাপ জমাতে শুরু এই টেলিফোনেই। কখনওবা প্রতিদিনের একঘেয়েমি দূর করে দিত টেলিফোনের একটা রিং। ক্রিং ক্রিং আওয়াজ তখন শ্রুতিমধুর মেদুরতায় জড়িয়ে রাখত আমাদের।
আজকের বর্তমান প্রজন্মের কাছে হয়তো এগুলো গল্প কথাই মনে হবে। তারা হয়তো বেশিরভাগই দেখেনি কালো টেলিফোনের সেই রূপ। এখন সবার হাতে হাতে বন্দী চলভাষ বা মোবাইল। তার কাছে এখন কেনই বা পাত্তা পাবে পুরোনো সেই টেলিফোন! তবে আজও স্মৃতির গভীরে হাতড়ালে হয়তো উঠে আসে টেলিফোন ঘিরে আমাদের পুরোনো নস্টালজিয়া। আজও কানে শুনতে পাই অঞ্জন দত্তের সেই বিখ্যাত গান – “এটা কি ২৪৪-১১৩৯, বেলা বোস তুমি পাচ্ছো কি শুনতে?” কে বলে স্মৃতিকে ভুলে থাকা এতই সহজ?
Discussion about this post