হুগলী জেলার বেগমপুর, খরসরাই, ছোট তাজপুর অঞ্চলে বেশিরভাগ তন্তুবায় সম্প্রদায়ের বাস। বেগমপুরী তাঁত শাড়ি সবার কাছে পরিচিত ও প্রসিদ্ধ। এখানে দুর্গাপুজোর নবমী তিথির ঠিক তিন মাস পরে শুক্লনবমী তিথিতে যন্ত্রের দেবতা বিশ্বকর্মাকে সাক্ষী রেখে পুজোর আয়োজন করা হয়। এটি অকাল বিশ্বকর্মা পুজো নামেও পরিচিত। আসলে যে সময় বিশ্বকর্মা পুজো হয়,সেই ১৭ সেপ্টেম্বর বা ভাদ্র মাসে তাঁতিরা আশ্বিনের দুর্গা পুজোর কাপড় বুনতে ব্যস্ত থাকতেন। তাই যন্ত্রের দেবতা বিশ্বকর্মা পুজো আনন্দের সঙ্গে করে উঠতে পারতেন না। এই কারণে নিজেরাই দুর্গা নবমীর তিন মাস পর শুক্ল নবমীতে এই পুজোর আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেন। বাড়ীর তাঁত যন্ত্রের পুজোতে শোলার ঘোড়ার ওপর সেপাই ও লেজের কাছে একটা ধানের শীষ গোঁজা মূর্তি প্রতিটি তাঁত যন্ত্রের পাটার ওপর বসিয়ে পুজো করা হয়।
এখানে প্রতিমার বিশেষত্ব হল ঠাকুরের বাহন হাতির পরিবর্তে ঘোড়া। চারটি হাতের পরিবর্তে হাত দুটি। তাঁত যন্ত্র যখন চলে তখন ‘মাকুর’ ডানদিক-বামদিক চালনার সময় ঘোড়ার ক্ষুরের চলার মতোই ‘খটা খট্’ আওয়াজ হয়। ঘোড়ার চলার সময় ক্ষুরের শব্দ, তাই তন্তুবায় বিশ্বকর্মা ঠাকুরের বাহন ঘোড়া। দু’হাতে তাঁত চালানো হয় তাই দুই হাতের বিশ্বকর্মা। এক হাতে থাকে ঘুড়ি বা তাঁতের মাকু অথবা চাঁদ মালা; অন্য হাতে আশীষ বাণী দান। বেগমপুর, খরসরাই, ছোট তাজপুর অঞ্চলে মোট প্রায় ৩৫ টি পুজো হয়।
আজ থেকে প্রায় ৬০ বছর আগে ১৯৬২ সাল (১৩৬৯ বঙ্গাব্দ) নাগাদ বেগমপুরের কাঁঠালতলায় প্রথম এই পুজো শুরু হয়েছিল। এই পুজো যারা শুরু করেছিলেন তাদের মধ্যে এখনও জীবিত হারাধন দত্ত জানালেন “শীতের অল্প ব্যস্ততায় তারক ভড়ের তাঁত শালে বসে নাটক, যাত্রা বা কী করা যায় আলোচনা করছিলাম। হঠাৎ প্রস্তাব আসে আমরা তো বিশ্বকর্মা পুজোয় আনন্দ করতে পারি না। তাই আমাদের যন্ত্রের পুজো করার জন্য বিশ্বকর্মার মূর্তি দিয়ে পুজো করা হোক। শুরু হল মূর্তি পুজো। প্রথমবার প্রতিমা কেনা হয়েছিল, দাম সাড়ে ছয় টাকা। পরের বছরও প্রতিমা কেনা হয়। তারপর তাঁত শিল্পী গৌড় কুন্ডু প্রতিমা বানান।” ১৯৯৬ সাল থেকে মহা সমারোহে জাঁকজমক করে পুজোর ব্যাপকতা শুরু হয়।
পুজোর দিনগুলি সরস্বতী নদীর তীরে বারুণী ঘাটা সংলগ্ন গ্রামের মাঠ ও চাষের ক্ষেতে চলে পেটকাটি, চাঁদিয়াল, ময়ূরপঙ্খী, মুখপোড়া ঘুড়িদের রাজত্ব। বাঙালির বড় উৎসব যদি হয় দুর্গাপূজা, তবে বেগমপুর অঞ্চলে অকাল বিশ্বকর্মা পুজো হল দ্বিতীয় দুর্গাপূজা। শীতকালীন বারোয়ারী মহোৎসব। পুজো উপলক্ষ্যে প্রায় সমস্ত বাড়িতে পেটপুজোর আয়োজনে খাসির মাংস এবং মোয়া থাকবেই। আগে পুজোর দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় তুবড়ি প্রতিযোগিতা হতো, পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকতো। অতীতে হ্যাজাকের আলোয় পুজো মন্ডপ আলোকিত হত। তারপর এল জেনারেটরের আলো। এখন বৈদ্যুতিক আলোয় তা উদ্ভাসিত।
মাটির তৈরী অকাল বিশ্বকর্মার প্রতিমা জনাই, বড়ার কুমারটুলী,বেগমপুর বারুণী ঘাটা,চাতরা শ্রীরামপুর থেকে নিয়ে আসেন। চন্দননগর থেকে আসে আলোকসজ্জা। অনেক ক্লাবের সদস্যরা ছোট বড় সবাই মিলে সুন্দর পুজো মন্ডপ তৈরী করে, যা চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তাছাড়া বিভিন্ন মাটির পুতুল মডেল দিয়ে বিভিন্ন প্রদর্শনী করে। যেমন বিয়ের অনুষ্ঠান ও বিয়েবাড়ি, মুখেভাত বা অন্নপ্রাশন, নোট বন্দী, নচিকেতার গানের সাথে তাল মেলানোর সেই বৃদ্ধাশ্রম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাট কবিতার ‘আমাদের ছোটো নদী’, ‘বসে আঁকো প্রতিযোগিতা’ প্রদর্শনী। এবারে করোনা ভাইরাসের মন্ডপ করেছে বরুণা ঘাটা সপ্তর্ষি ক্লাব।
ব্যক্তিগত চাঁদা ছাড়াও কোনও কোনও ক্লাব পুকুর লিজ নিয়ে মাছ চাষ করে তার অর্থে পুজো করে। বেশ কিছু পুজো কমিটির ছেলেরা কাজের ফাঁকে নিয়মিত ক্লাবে ‘বসানা’ করে যে অর্থ পায় তা জমিয়ে পুজো করে।’বসানা’ হল,তাঁতের যে ভাঁজটা পুরো কাপড় গুটিয়ে তৈরী করা হয়, সেটা সারাদিন ধরে ‘ব’ ও ‘সানা’ এর মাঝে গেঁথে গেঁথে সুতোগুলো নিয়ে আসতে হয়। সারা বছর ধরে এই পরিশ্রমের মজুরী থেকে পাওয়া অনুদানে একটা বেশ বড় অঙ্কের অর্থ সংগৃহীত হয়।
অতীতে খরসরাই তন্তুবায় সমবায় সমিতি পুজো উপলক্ষ্যে প্রত্যেক তাঁতশিল্পী সদস্যকে দুটো ছুটির পারিশ্রমিক এককালীন ষাট টাকা দিত। সমবায় সমিতির অধীন সব বারোয়ারী কমিটিকে তাঁত কাপড়ের ব্যবসায়িক লাভ থেকে নির্ধারিত চাঁদা দিত। পুজোর প্রসাদ বিভিন্ন ফল,মিষ্টি কিন্তু অবশ্য উপাচার তিলের খাজা ও চিনি বা নলেন গুড়ের মোয়া। প্রতিমা বিসর্জন বারুণী ঘাটে সরস্বতী নদীতে,স্নানের ঘাটে বা স্থানীয় পুকুরে করা হয়। বিসর্জন শেষে চলে খিচুড়ি খাওয়ার পর্ব।
মুসলিম ও হিন্দুরা গায়ে গা লাগিয়ে সহবস্থান করছেন। একে অপরের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। “সারা ভারতবর্ষ জুড়ে ধর্মীয় টেনশন হলেও এখানে কোনোদিন কোনো টেনশন আমাদের মধ্যে হয়নি”, জানালেন ছোটো তাজপুর সেনপাড়া সম্মিলনী ক্লাবের সদস্য বনমালী দে। এই উৎসবে প্রতিমা,পুজো-প্যান্ডেল এবং রকমারী চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জার বাজেট থাকে লাখের উপরে। কিন্তু এ বছর অতিমারি পরিস্থিতির জন্য সেসব প্রায় পঞ্চাশ হাজারেরও কম। পুজো প্যান্ডেলের সামনে মেলা বসাও বন্ধ। প্রশাসনের নিয়ম মেনে চলতে হচ্ছে। তবুও চারদিন ধরে উৎসব চলছে, অতিমারির জন্য জাঁকজমক কম হলেও পুজোর আয়োজন ত্রুটিহীন। তাই দেখে যেতেই পারেন তাঁত বিশ্বকর্মা পুজো।
প্রতিবেদক ড. সমরেন্দ্র নাথ খাঁড়া
Discussion about this post