ঠিক কাকে ভেবে বিশ্বকবি ‘ওগো বিদেশিনী’ গানটি লিখেছিলেন, তা আজও রহস্যে ঘেরা। তবে এ গান লেখার প্রায় ৩০ বছর পর লাতিন আমেরিকার আর্জেন্টিনায়, কবি তাঁর সেই বিদেশিনীকে খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি হলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, আর্জেন্টিনার এক নারীবাদী লেখিকা ও সাহিত্যিক। রবীন্দ্রনাথের সাথে তার পরিচয় এই সাহিত্যের হাত ধরেই। রবীন্দ্রনাথ ‘বিজয়া’ নামে আমাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করান। তবে বিজয়াই হোক বা ভিক্টোরিয়া, কবির সঙ্গে তাঁর এক গভীর সখ্যতা ছিল। কেউ অবশ্য এটিকে প্রেম বলেও আখ্যা দেন। সাত সমুদ্র পারের এক বিদেশিনীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কীভাবে এমন রহস্যময় এক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল? এই প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে গেলে অতীতে নজর ফেরাতে হবে আমাদের।
ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে চেনার আগে থেকেই তাঁর সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটে ভিক্টোরিয়ার। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাওয়ার পর ভিক্টোরিয়ার হাতে এসে পড়ে গীতাঞ্জলীর ইংরেজি, স্প্যানিশ ও ফরাসি ভাষার অনুবাদ। গীতাঞ্জলী পড়ে রবীন্দ্রনাথের রীতিমত একজন ভক্ত হয়ে ওঠেন তিনি। এমনকি ‘রবীন্দ্রনাথ পড়ার আনন্দ’ নামে একটি লেখাও সেই সময়ে লিখে ফেলেন তিনি। ইতিমধ্যেই ১৯২৪ সালে পেরুর স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে পেরুর দিকে সমুদ্রযাত্রা শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু মাঝপথে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় বাধ্য হয়ে তাঁকে কিছুদিন আর্জেন্টিনার প্লাসা হোটেলে থাকার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কবি আর্জেন্টিনায় রয়েছেন একথা জানতে পেরে তাঁর ভক্ত ভিক্টোরিয়া কিছুতেই এ সুযোগ হাতছাড়া করেননি। নভেম্বরের শুরুতেই এক দিন রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করতে চলে আসেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো।
এরপর হোটেল থেকে ‘মিলারিও’তে পৌঁছে একটি বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়। বাড়িটি ওকাম্পো ভাড়া নেন নিজের হীরের টায়রা বিক্রি করে। সে বাড়ির পাশ দিয়ে লা প্লাতা নদী বয়ে চলেছে। কবিগুরু যেদিন মিলারিওতে পৌঁছলেন, সেদিনই তিনি ‘বিদেশী ফুল’ কবিতাটি লেখেন। তারপরে কবি ‘অন্তর্হিতা’, ‘আশঙ্কা’ এবং ‘শেষ বসন্ত’ নামে আরও তিনটি কবিতা লিখলেন। এই কবিতায় এতই তীব্র প্রেমের প্রকাশ ছিল যে, কবিতাগুলি রবি ঠাকুর দেশে তার পুত্র ও পুত্রবধূদের পাঠাতে নিষেধ করেছিলেন। মিলারিওর বারান্দায় একসঙ্গে বসে রবীন্দ্রনাথ এবং ভিক্টোরিয়া কখনও নদী দেখতেন। আবার কখনও বাড়ির কাছে তিপা গাছের নিচে বসে আড্ডা দিতেন। রবীন্দ্রনাথ বাংলা কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন বিজয়াকে, বিজয়াও শোনাতেন শার্ল বোদলেয়ারের কবিতা। সময়টাকে পুরোদমে উপভোগ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
১৯২৫ সালে ভিক্টোরিয়াকে তার প্রকাশিত ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেন রবীন্দ্রনাথ। উৎসর্গপত্রে তিনি লিখেছিলেন- ‘বিজয়ার করকমলে’। তিনি যে একটি বই ভিক্টোরিয়াকে উৎসর্গ করেছেন সেটি আর্জেন্টিনায় চিঠি লিখেও জানিয়েছিলেন। আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “বইখানা তোমায় উৎসর্গ করা, যদিও এর ভিতরে কী রয়েছে তা তুমি জানতে পারবে না।” ভিক্টোরিয়াও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পুরো একটি বই লিখে ফেলেন । ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর বই ‘Tagore en las barrancas de San Isidro’, বাংলায় ‘সান ইসিদ্রোর উপত্যকায় ঠাকুর’ বা ‘সান ইসিদ্রোর উপত্যকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বায়োপিক ‘থিঙ্কিং অব হিম’ সিনেমাতেও বিজয়ার সঙ্গে তাঁর এই সখ্যতার কাহিনী উঠে এসেছিল।
১৯২৪ সালে আর্জেন্টিনায় দেখা হওয়ার পর ১৯৩০ সালে আবার প্যারিসে দেখা হয় তাঁদের। প্যারিসে রবীন্দ্রনাথ একটি চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে চেয়েছিলেন। সেই সময়ে এটি ছিল অত্যন্ত খরচ-সাপেক্ষ এবং অনুমতি-সাপেক্ষ একটি বিষয়। শোনা যায় এক বছর আগে আবেদন করে মিলত সেই প্রদর্শনী আয়োজনের অনুমতি। ওকাম্পো মাত্র এক মাসের মধ্যে সেই অনুমতি সহ প্রদর্শনী আয়োজনের ব্যবস্থা করে দেন। সেখানে রবি ঠাকুরের ১২৫ টি ছবিই বিক্রি হয়। ছবি বিক্রির টাকা বিশ্বভারতী তহবিলে দেওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়াকে বারবার শান্তিনিকেতনে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। একাধিক বার ভিক্টোরিয়া শান্তিনিকেতন আসেন বলে শোনা যায়। তাঁর মধ্যে একটি বার শান্তিনিকেতন ভ্রমণের কথা ভিক্টোরিয়া নিজেই লিখেছেন তাঁর লেখায়। তবে দেখা না হলেও নিয়মিতই টেলিগ্রামে বার্তা আদান-প্রদান হতো। একেবারে শেষ চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে লিখেছিলেন, “এতোদিন পরে তোমার আমাকে মনে পড়ল – কী যে ভালো লাগছে! পৃথিবীর সব রঙ ফিকে হয়ে আসছে যখন, বিমর্ষ মন কেবল তাদের নৈকট্যই কামনা করে যাদের স্মৃতি সুখময় দিনগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে। যতো দিন যায়, সেই স্মৃতিগুলো যেন গাঢ় হতে থাকে।” এরপর রবীন্দ্রনাথ যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন, তখন তার পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছিলেন ভিক্টোরিয়া। নিজের গাড়িতে বসে রেডিওর মাধ্যমে ঠাকুরের মৃত্যু সংবাদ জানতে পেরেছিলেন ভিক্টোরিয়া। মৃত্যুর চার মাস আগে ভিক্টোরিয়াকে ভেবে লেখা রবীন্দ্রনাথের কবিতাটি পুত্র রথীন্দ্রনাথ পৌঁছে দিয়েছিলেন তাঁর কাছে।
নাহ! রবীন্দ্রনাথ আর ভিক্টোরিয়ার ঠিক কি সখ্যতা ছিল তা আর জানা যায় না। তবে যদি তা প্রেমই হয়, তাহলে সেই প্রেম ছিল নিষ্পাপ প্লেটোনিক প্রেম। বয়স আর দূরত্বের কাছে হার মেনেছিল এ প্রেম! এ প্রেম ছিল বাঁধনহীন এক ঐতিহাসিক সম্পর্ক। কামের এতটুকু ছোঁয়াও তাতে ছিল না। কবি চন্ডীদাসের ভাষায় – “রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম কাম-গন্ধ নাহি তায়!”
চিত্র ঋণ – parabass.com, tumblr.com
Discussion about this post