বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে একটি বেতার কেন্দ্র এবং একদল মানুষের কন্ঠ, শক্তি জুগিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের। বাংলাদেশ তাদের কন্ঠযোদ্ধা বলেই জানে, তারা মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে কম নয়। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিহত করতে গেরিলা পদ্ধতির পাশাপাশি সহায়তা করেছিল ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। গোটা দেশের মুক্তিকামী মানুষকে এক সুতোয় বেঁধে রেখেছিল এই বেতার কেন্দ্র ও তার কন্ঠযোদ্ধা বা শব্দযোদ্ধারা।
১৯৭১-এর ২৬ মার্চ দুপুর ২ টোয় আগ্রাবাদের বাদামতলী বেতার কেন্দ্রের থেকে আওয়ামী লিগ নেতা এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার বার্তা পাঠ করেন। নিরাপত্তার কারনে বেতারকেন্দ্রটি কালুরঘাটে স্থানান্তর করা হয়। শুরুতে নাম ছিল ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’। কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে এই বেতারকেন্দ্র সংগঠিত হয়েছিল চট্টগ্রাম বেতারের দশ জন কর্মী, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও জনগণের সহযোগীতায়। ২৮ মার্চ মেজর জিয়ার অনুরোধে এই বেতারকেন্দ্রের নাম থেকে ‘বিপ্লবী’ অংশটি বাদ দিয়ে হয় ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। এই বেতার কেন্দ্রের যাত্রা শুরুর চারদিনের মধ্যেই আক্রমণ নেমে আসে। ৩০ মার্চ পাকিস্তানী বাহিনীর বোমা বর্ষনে বন্ধ হয়ে যায় বেতার কেন্দ্রটি। স্বাধীন বাংলা বেতারের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ভারতের ত্রিপুরার বাগাফা জঙ্গল ও আগরতলায়।
স্বাধীন বাংলা বেতারের তৃতীয় পর্ব শুরু হয় ২৫ মে কলকাতার বালিগঞ্জ প্যালেস থেকে। মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেরণা দিতে রচিত হতে থাকে গান, কথিকা, নাটক। ওইদিন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলায় শোনা গেল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সূচনা সঙ্গীত ‘জয় বাংলা,বাংলার জয়’। ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল’, ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম’, ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’-এরম আরও অনেক কালজয়ী গান মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করত, শিরায় শিরায় উন্মাদনা জাগাত সাধারণ মানুষের। সেইসব দিনের কন্ঠযোদ্ধারা আজও মনে করেন যে, স্বাধীনতা যুদ্ধে একটি বেতার কেন্দ্রের ও গানের এমন অবদান বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। পেশাগত স্টুডিওর মতো রেকর্ডিংয়ের ভালো ব্যবস্থা ছিল না, ছিল না প্রয়োজনীয় বাদ্যযন্ত্রও। তবু কোনোকিছুই কন্ঠযোদ্ধাদের কন্ঠকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।
যুদ্ধের দিনগুলোতেও হাসির রসদ জুগিয়েছিল ব্যাঙ্গাত্মক অনুষ্ঠান ‘চরমপত্র পাঠ’। এই অনুষ্ঠানটিই ছিলো সবচেয়ে জনপ্রিয়। দেশাত্মবোধক গানের বিশেষ অনুষ্ঠানের নাম ছিল ‘জাগরণী’। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দ্বিতীয় ফন্ট হিসেবে কাজ করেছিল স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র। কন্ঠযোদ্ধারা তাদের লেখনি, বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অনস্বীকার্য অবদান রেখেছে। শোনা যায় এই গানগুলি মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশন সংকেত হিসেবে কাজ করতো, নির্দিষ্ট গান সম্প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুঘাঁটিতে হামলা চালাত। কন্ঠসৈনিকদের উদাত্ত কন্ঠ, আগুন ঝরানো গান গোটা দেশের মানুষের চেতনার দরজায় কড়া নেড়েছিল। বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধদিনে পরম বন্ধুর মতো ভরসা করেছিল এই বেতার কেন্দ্রের ওপর।
প্রচ্ছদ চিত্র ঋণ – প্রথম আলো
Discussion about this post