পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা নদিয়া। প্রাচীনকালে এখানে অনেক রাজা রাজত্ব করেছেন। এক এক সময় এখানকার এক এক জায়গা রাজধানীতে পরিণত হয়েছিল। তেমনই একসময় নদিয়ার রাজধানী ছিল শ্রীনগর। বলা যায়, নদিয়া জেলার বুকে লুকিয়ে থাকা এক অজানা ইতিহাসের সাক্ষী – শ্রীনগর। নদিয়া জেলার বেলে গ্রাম থেকে ৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত শ্রীনগর গ্রাম। এটি এককালে ‘মর্দ্দানা’ নামে পরিচিত ছিল। প্রাচীনকালে এই গ্রামটির পাশ দিয়ে প্রবাহিত হত মরালী নদী। যশড়ার ইমামবাড়ার কাছে গঙ্গা থেকে ভাগ হয়ে গেছে মরালী নদী। এই নদীটি নদিয়া জেলার মধ্যে দিয়ে চলে গেছে দক্ষিণের দিকে এবং নহাটার কাছে গিয়ে যমুনা নদীর সাথে মিশেছে। কিন্তু বর্তমানে মরালী নদী বিলুপ্তপ্রায়। নদীটি মজে গিয়ে খালে পরিণত হয়েছে। তবে একসময় যেমন এই নদীর স্রোত ছিল তেমনই নদীটি ছিল প্রশস্ত।
১৬৪০ খ্রীষ্টাব্দে নদিয়ার রাজা রাঘব রায় নৌকাযোগে এই স্থানে এসে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের প্রতি মুগ্ধ হয়ে যান। তারপর তিনি এখানে বসবাসের জন্য একটি পরিখা বেষ্টিত সুরম্য রাজপ্রাসাদ ও বেশকিছু মন্দির নির্মাণ করেন। সঙ্গে স্থানটির নামকরণ করেন ‘শ্রীনগর’। এরপর রাজধানী হিসেবে শ্রীনগর দীর্ঘ সময় ধরে বাণিজ্য, শিল্প ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
পরবর্তীকালে আস্তে আস্তে শ্রীনগরের শ্রী ম্লান হতে শুরু করে। যমুনা ও মরালী নদীর সংযোগস্থলে মাইলব্যাপী চড়া পড়ে যায় ফলে মরালী নদীর গতিপথ রুদ্ধ হয়ে যায়। ফলত শ্রীনগর সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বাইরের জগৎ থেকে। কারণ প্রাচীনকালে মূলতঃ যাতায়াতের পথ ছিল নদী। এরপর সেইসময়ের নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র শ্রীনগর ত্যাগ করে চলে যান কৃষ্ণনগরে। পড়ে থাকে শ্রীনগরের রাজপ্রাসাদ, দেবদেবীর মন্দির এবং এখানকার অধিবাসীরা। এরপর ১২০০ সালে দেখা দেয় মহামারী। মহামারীর প্রকোপে শ্রীনগর পরিণত হয় মহাশ্মশানে। জনশূন্য হয়ে পড়ে এই গ্রাম এবং সময়ের সাথে সাথে মানুষজনের মন থেকে মুছে যায় শ্রীনগরের অস্তিত্ব।
অবশেষে ১৩২৭ সালে বাংলাদেশের ফরিদপুরের কানাইলাল দাস রায় তৎকালীন শাসকের থেকে এই শ্রীনগর গ্রামটি মালিকানা পায়। এরপর তিনি অঞ্চলটির বনজঙ্গল পরিষ্কার করে চাষ করার উপযুক্ত করে তোলেন। পুনরায় গ্রামে বসতি স্থাপন হয়। তবে বর্তমানে শ্রীনগর আর আগের মতো নেই। এখন এটি একটি কৃষি প্রধান গ্রাম। রাজা রাঘব রায় নির্মিত মন্দিরগুলিও আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। রাজবাড়ির প্রধান ভবনটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এবং এর দেয়াল ও ছাদ ভেঙে পড়েছে। সেই সুরম্য রাজপ্রাসাদের স্থানে এখন তৈরি হয়েছে কারখানা এবং ইটভাটা। তবে স্থানীয়দের মধ্যে শ্রীনগরের রাজকীয় ইতিহাসের কিছু স্মৃতি এখনও রয়ে গেছে।
চিত্র ঋণ – দিবেন্দু ভট্টাচার্য্য
Discussion about this post