মাতৃভাষা দিবস। কথাটা বলতে খুবই সহজ এবং বেশ সোজাসাপ্টা। আর দিনটা পালনের সময়ও বেশ কিছু সাহিত্যসুলভ লেখা কিংবা ক’টা গানের কলি। কিন্তু এইটুকু কথার মধ্যেই লেগে বহু মানুষের কাঁচা রক্তের দাগ। রয়েছে নিজের মাতৃভাষাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে বাঁচার লড়াই। না আজ সেই বাংলা ভাষার আন্দোলনের কথাটা বলব না। কিন্তু তেমনই এক মাতৃভাষার তাগিদে সংগঠিত আন্দোলনের কথা হয়তো অনেকেরই অজানা। যেখানে শুধুই স্কুল কলেজের পড়ুয়ারা একজোট হয়ে লড়ে গিয়েছিল আমৃত্যু।
দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ শহরের কাছে ছোট্ট অঞ্চল সোয়েটা। আফ্রিকান ব্ল্যাকরাই ওখানের আদি নিবাসী। ওদের ভাষা মূলত জুলু। কিন্তু স্কুল কলেজের পড়াশোনায় লিঙ্গুয়া, ফ্রাঙ্কা ও ইংরেজিই প্রধান ছিল। ওদিকে শাসকগোষ্ঠী অর্থাৎ ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গরা আদবকায়দায় ব্যবহার করত জার্মান-ডাচ ভাষার সংমিশ্রণে ইন্দো-ইউরোপীয় (আফ্রিকানস) ভাষা। ১৯৭৬ সাল। সর্বস্তরে একই ভাষায় শিক্ষাব্যবস্থা চালুর লক্ষ্যে শাসকগোষ্ঠী স্কুলগুলোতে ফাইভ পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম করল ইংরেজি এবং আফ্রিকানস ভাষাকে বাধ্যতামূলক করে ফেলল। গণিত ও সামাজিক বিজ্ঞানের জন্য আফ্রিকানস ভাষা এবং সাধারণ বিজ্ঞান ও ব্যবহারিক বিষয়ের (গার্হস্থ্য এবং কর্মমুখী শিক্ষা) জন্য ইংরেজি ভাষা স্থির করা হল। চরম অসুবিধের স্বীকার হল আফ্রিকার কালো পড়ুয়ারা।
গর্জে উঠল ছাত্রসমাজ। গভীর অসন্তোষ দেখা দিল স্কুলসড়ুয়াদের মা-বাবা, শিক্ষক-শিক্ষিকার মধ্যে। আর সহ্যের বাঁধ ভাঙল ১৯৭৬ সালের ষান্মাসিক পরীক্ষার সময়। আফ্রিকান কালো ছাত্রছাত্রীদের বাধ্য করা হল আফ্রিকানস ভাষায় পরীক্ষা দিতে। ছাত্ররা বিদ্রোহ শুরু করে। ১৯ বছরের এক ছাত্র সেইতসি মসিনিনি ডাক দিল গণবিক্ষোভের। ঠিক হয় ১৬ জুন বুধবার শুরু হবে আন্দোলন। শীতল আবহাওয়ার মাঝেও রক্ত ফুটছে সেদিন সব কালো ছাত্রদের। ব্যাগ থেকে বেরোলো বড় বড় প্ল্যাকার্ড পোষ্টার। স্কুল ইউনিফর্ম পরা বিশ হাজার ছাত্রছাত্রীর মিছিলে ফেটে পড়ল চতুর্দিক। পুলিশ ডগ স্কোয়াডের কুকুর লেলিয়ে দিল তাদের পেছনে। টিয়ার গ্যাস ছাড়া হল পুরো মাত্রায়। কিন্তু ছাত্ররা একচুলও পিছু হটেনি। এগিয়ে চলল মাথা উঁচিয়ে।
কোনোভাবেই যখন থামানো গেল না ছাত্রদের শেষমেশ চলল পুলিশি গুলির তান্ডব। নির্মমতার এক চূড়ান্ত অধ্যায়ে বর্বরতার সীমা ছাড়িয়ে দিল সরকারি পুলিশ। গুলির ঘায়ে লুটিয়ে পড়ল জনা কুড়ি কচি মুখ। প্রায় দুশো ছাত্র ঘায়েল হয়ে পড়ে আঘাতে। তবুও থামল না আন্দোলন। দাবানলের মতো পাশের শহর প্রিটোরিয়া, ডারবান এবং কেপটাউনে ছড়িয়ে পড়ল বিদ্রোহ। দক্ষিণ আফ্রিকার এশীয় বংশদ্ভূত ছাত্ররাও যোগ দিল এতে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ৪৫১ জন মারা যায় ও ৩,৯০৭ জন আহত হয় এই আন্দোলনে। আফ্রিকান জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে এবার বিদ্রোহ নতুন মোড় নেওয়া শুরু করে। বিদ্রোহের আঁচ বুঝে সরকার তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য হয়।
১৯৯৪ সাল। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে স্বাধীনতা লাভ করল সোয়েটা অঞ্চল এবং বর্ণ বৈষম্যেরও দফারফা ঘটল। কচিকচি মুখগুলোর কালঘাম ও রক্তেই কালোরা সেদিন প্রতিষ্ঠা করে নিজস্ব দাবি। মাতৃভাষাকে বুকে আঁকড়েই বিশ্ব ইতিহাসে জায়গা করছিল এই সোয়েটা।
চিত্র ঋণ – roar media
Discussion about this post