ধোবিঘাট বলতেই আমাদের মনে পরে মুম্বাইয়ের মহালক্ষী ধোবিঘাটের কথা, যার পত্তন হয়েছিল ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না, দক্ষিণ কোলকাতায় রিচি রোডে আছে এই শহরের প্রাচীনতম ধোবিঘাট, যার নাম সাউথ ধোবিখানা। ইংরেজ আমলে (১৯০২ সাল) এর পত্তন হয়েছিল, একটি আপৎকালীন পরিষেবা হিসেবে। এখানকার ধোপারা বংশানুক্রমে এই কাজ করে চলেছেন, যারা বেশিরভাগই উত্তরপ্রদেশ বা বিহার থেকে এসেছিলেন। বর্তমানে এখানে কাজ করেন প্রায় ২৩৫ জন লাইসেন্সপ্রাপ্ত ধোপা এবং তাদের সহকারীরা।

রিচি রোডে বড় রাস্তার থেকে একটু ভিতরে গলির মধ্যে ঢুকলেই চোখে পড়বে একটা পুরোনো প্রবেশদ্বার, যার ওপরে কাঠের তক্তা দিয়ে সাইনবোর্ড ঝোলানো। তাতে ঝাপসা অক্ষরে লেখা আছে…“SOUTH DHOBIKHANA ESTD. 1902″. ভিতরে ঢুকলে দুদিকে কিছু অস্থায়ী বাড়ির মধ্যে দিয়ে চলে গেছে মূল ধোবিঘাটের দিকে রাস্তা। চারদিকে দড়ি টানিয়ে শুকোতে দেওয়া হয়েছে নানান রঙের কাপড়, যাদের মধ্যে সাদা রংই বেশি। কাকভোর থেকে এখানে শুরু হয়ে যায় কর্মকান্ড। কাপড়গুলো আগেরদিন রাতেই সাবান জলে ভিজিয়ে রাখা থাকে। সাদা কাপড়গুলো বেশি করে শুভ্রতা আনার জন্য ব্লিচে ভেজানো হয়। ভেজানোর জন্য ব্যবহার করা হয় পুরনো বাথটাব, গামলা, ড্রাম ইত্যাদি। একটা লম্বা চৌবাচ্চার দুই পাশ দিয়ে কাপড় কাচার জায়গা বানানো আছে। সেখানে আছে ছোট ছোট খুপরি, একটা করে কাপড় আছড়ানোর বেদী-সহ। আমি গুণে দেখেছি, সব মিলিয়ে ১৮০টি খুপরি ও বেদী আছে।

এই বেদীতে কাপড় আছড়ে ধুয়ে নেবার পরে, জল ঝরানোর জন্য রয়েছে স্টিলের ড্রামের মতো দেখতে হস্তচালিত ড্রায়ার মেশিন। সেখানে হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে কাপড়ের জল নিংড়ে নেওয়া হয়। আগে কিছু ছোট ছোট চুল্লি ছিল, সেখানে আগুন দিয়ে কাপড় শুকনো করা হতো, কিন্তু এখন সেগুলো পরিত্যক্ত ও ভগ্নদশায় রয়েছে। এরপর কাপড়গুলো দড়িতে মেলে শুকিয়ে নিয়ে, কয়লার ইস্তিরি দিয়ে প্রেস করে নেওয়া হয়। রেডি কাপড়গুলো সাইকেল, মোটরবাইক বা রিকশা করে ডেলিভারি দিয়ে আসা হয়। এখানে মূলতঃ হাসপাতাল, হোটেল ও ধর্মশালার থেকেই জামাকাপড় আসে দেখলাম। এছাড়াও অনেক গৃহস্থবাড়ি থেকেও কাপড় আসে।

এবার আসা যাক এখানকার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে। মুম্বাইতে যেমন ধোবিঘাটকে একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে, তেমন এখানে কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয় নি। ব্রিটিশ আমলে এটিকে কখনোই একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা হয় নি, তাই এখানের সেবামূল্য তেমন বেশি ছিল না। এখনো বাইরের কোনো ভালো লন্ড্রির থেকে এদের দাম কম। কিন্তু বর্তমানে সরকার এই জায়গাটি সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহী নয়, তাই সর্বত্র অযত্নের চিহ্ন স্পষ্ট। সময়ের সাথে সাথে ধোপাদের সংখ্যা অনেক কমে যাচ্ছে, কারণ নতুন প্রজন্মের ছেলেরা এদিকে তেমন উন্নতি না দেখে অন্যান্য পেশার সাথে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। সরকার যদি সত্ত্বর এই অঞ্চলের উন্নতিসাধনে হাত না দেয়, তবে একটা সময়ের পরে এটি শুধুমাত্র একটি ধোপাদের পাড়া হয়েই থেকে যাবে।
চিত্র ঋণ – Calcutta Kahini







































Discussion about this post