প্রশ্ন: সঙ্গীতের সঙ্গে প্রেমের এই সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেন কিভাবে?
সৌম্যদীপ: খুব ছোট বয়স থেকেই। জন্ম থেকে বাড়িতে গানের চর্চা দেখে আসছি। মা একজন সংগীতশিল্পী, বাবা লেখালিখি করতেন। তবে, একেবারে প্রেমে পরা বা প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করলাম, যেদিন নিজে প্রথম গান লিখলাম, আর গাইলাম, আর মানুষের কাছে আস্তে আস্তে প্রশংসা পেতে শুরু করলাম। তারপর থেকেই একটার পর একটা গান বানাবার তাগিদ অনুভব করলাম।
প্রশ্ন: একজন সফল সঙ্গীত শিল্পী হতে গেলে প্রতিভাই কি যথেষ্ট, নাকি সোর্স শেষ কথা?
সৌম্যদীপ: আমি বিশ্বাস করি প্রতিভাই যথেষ্ট। সোর্স অনেকটা ‘add on’এর মত বিষয়। প্রতিভা এবং অনুশীলনের কোনো বিকল্প আছে বলে মনে করিনা। প্রতিভাশালী মানুষ একটা জায়গা পর্যন্ত যেতে বাধ্য। সোর্স একটা বড় জায়গা, প্রমোশন, মানুষের কাছে পৌঁছন দরকার। তবে অনুশীলন আর প্রতিভা ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়। বড় শিল্পীরা, যদি সেই ছোট অনামী মানুষের কাজকে একটু এগিয়ে দেন, তাহলে চলার পথটা অনেকটা মসৃণ হয়। তবে প্রতিভা কে এগিয়ে না দিলেও সে ফুটে উঠবে, আবার তাকে রুখে দেওয়াও যাবেনা।
প্রশ্ন: “বোকারা স্বপ্ন দেখে পৃথিবীটা সাজাবার”- আপনি নিজেকে কী এই বোকাদের দলে ফেলবেন?
সৌম্যদীপ: অবশ্যই। আমিও বোকাই। এখন বাংলার মৌলিক গান বাজনার জগতের যা অবস্থা! সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজের গানকে মানুষের কাছে ছড়াতে চাইছি, তাই চালাক তো কোনোভাবেই নই।
প্রশ্ন: সাম্প্রতিক যেসব ঘটনা আমাদের ভাবাচ্ছে, পোড়াচ্ছে অথবা আলোকিত করছে, সেসব ঘটনা আপনার গানের কথায় কতটা ছাপ ফেলছে?
সৌম্যদীপ: প্রচণ্ডভাবে ছাপ ফেলছে। কারণ এই ধরনের ঘটনা আমার উপর ভীষণভাবে প্রভাব ফেলে, এবং যে বিষয় আমার উপর এতখানি প্রভাব ফেলতে পারে, তাকে যতক্ষণ না আমি লিখে ফেলতে পারি, ততক্ষণ আমার মনের ওই যন্ত্রণা, বা ভালোলাগা, বা আনন্দ বা দুঃখের উপশম হয়না। ওই লেখা ছাড়া নিজেকে যেন প্রকাশ করতে পারিনা।
প্রশ্ন: একজন সঙ্গীতশিল্পী তাঁর প্রতিটি গান বাঁধেন একই পরিশ্রম, নিষ্ঠা, ভাবনা দিয়েই। তবু কিছু কালজয়ী গান ছাড়া, বাকিগান সেইভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনা কেন?
সৌম্যদীপ: শিল্পীর কাছে তাঁর প্রতিটি গানই সন্তানসম। প্রতিটি গানই একটি বিশেষ গল্প থেকে তৈরি হয়। কিন্তু, সেই গান যখন মানুষের কাছে পৌঁছয়, তখন মানুষের কিন্তু সেই বিশেষ গল্পকে জানা, বা খুঁজে দেখার দায় থাকেনা। সে গান শোনে নিজের মত করে। আমি মনে করি, সুর যদি ক্যাচি হয়, তবে সেই গান অনেকের কাছে পৌঁছতে পারে। আমার মনে হয় ৭০% মানুষ সুরের দিকেই আগে ঝোঁকেন। কথার দিকে ঝুঁকলে বাণিজ্যিক গানগুলো এত সাফল্য পেত না। ফলে, সুর যে গানের আকর্ষণীয় হবে, মানুষ সেই গানকেই বেশি পছন্দ করবে। কোনো শিল্পীরই সব গান সকলের পছন্দ হতে পারেনা, তিনি যতই বিখ্যাত হোন না কেন! তবে শিল্পীর কাছে তাঁর প্রত্যেকটা গানই প্রিয়।
প্রশ্ন: AI বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর যুগে বাংলা মৌলিক গানের ভবিষ্যত কী?
সৌম্যদীপ: AI অনেকটা ওই বিজ্ঞানের সুফল কুফলের মত ব্যাপার। AI ব্যবহার হবে টেকনোলজিতে, রেকর্ডিংয়ের ক্ষেত্রে। গলার ব্যালেন্স ঠিক করা, গলাকে গানের উপযোগী করে তোলা ইত্যাদি। কিন্তু, যার গলায় সুর নেই, তাকে যদি AI সুরেলা বানিয়ে দেয়, সেটা হবে ভীষন ক্ষতিকর। তবে, আমার মতে, যতই যাই হোক র ট্যালেন্ট শেষপর্যন্ত থেকে যাবেই। AI সেটা কখনোই কেড়ে নিতে পারবে না।
প্রশ্ন: রিয়েলিটি শো কী আদৌ শিল্পী তৈরি করে? নাকি শুধুই তারকা?
সৌম্যদীপ: আমি যতটুকু, যে অল্প পরিসরে দেখেছি, আমার মনে হয়েছে শিল্পী নয়, তারকাই তৈরি করে। এসব জায়গায় যেভাবে পলিটিক্স চলে, যেভাবে মানুষ মানুষকে ঠকায়, সেখানে কোনো শিল্পী থাকতে পারেন বলে আমার মনে হয়না। আমার মতে, রিয়ালিটি শোয়ের থেকে করাপ্টেড জায়গা, নোংরা জায়গা আর নেই। আমি নিজে না রিয়েলিটি শো তে না গেলেও, আমার চেনাপরিচিতদের অভিজ্ঞতা যা শুনেছি, তা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর।
প্রশ্ন: আপনার কী মনে হয়, যে আমাদের দেশ এই মুহূর্তে একটা ফ্যাসিস্ট শাসনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে? যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলে সমস্ত শিল্পীরা সাংস্কৃতিকভাবে একজোট হতে পারছেন না কেন?
সৌম্যদীপ: আসলে, এই মুহূর্তে এক শ্রেণীর শিল্পী আছেন, যাঁরা একে অপরকে টেনে নামাতে ব্যস্ত। দুই শিল্পীর মধ্যে শিল্প সংক্রান্ত পারস্পরিকতা নেই বললেই চলে। খুব শিল্পী এখন পাওয়া যাবে, যাঁরা অন্যের কাজকে নিঃস্বার্থভাবে সাপোর্ট করছেন। তাই, যতক্ষণ না শিল্পী, মানুষকে প্রাধান্য না দিয়ে শিল্পকে প্রাধান্য দিচ্ছেন; ততক্ষণ একে অপরের সঙ্গে একজোট হওয়া সম্ভব নয়।
প্রশ্ন: নতুন শিল্পীরা যখন কোনো অনুষ্ঠানে গাইতে যান, তাঁদের পারিশ্রমিক ঠিক দেওয়া হয়না এবং আরও বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয়, এই বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
সৌম্যদীপ: আমার সঙ্গে এই ঘটনা খুবই কম ঘটেছে। আমি সবসময় শোয়ের আগে বুকিংয়ের সময় ৫০% পারিশ্রমিক নিয়ে নিই, এবং মঞ্চে ওঠার আগে বাকিটা। তবে, সব ক্ষেত্রে এমনটা না হতেই পারে। তাই আমি বলব যখন শো আসছে, পারিশ্রমিক অর্ধেক নাও, এমন কারা শো করছেন, কোথায় যাচ্ছ সেই সম্পর্কে ভালো কর খোঁজ খবর নিয়ে তারপর শো করতে যাও। শুধু ছোট কেন, অনেক বড় মাপের শিল্পীর সঙ্গেও এমন হয়েছে, যে পারিশ্রমিক আটকে রাখা হয়েছে, এক ঘণ্টার জায়গায় জোর করে তিনঘন্টা গান গাইতে বাধ্য করা হয়েছে। তাই, শোয়ের অর্গানাইজার এবং শিল্পীর মধ্যে বোঝাপড়া থাকাটা খুব প্রয়োজন।
প্রশ্ন: বাংলা ব্যান্ড নিয়ে পলিটিক্সের কানাঘুষো আকছার শোনা যায়, বাস্তবে তার রূপটা কতটা শোচনীয়?
সৌম্যদীপ: ওইতো আগের একটা প্রশ্নে বললাম, শিল্প আর মানুষ দুটোকে মানুষ খুব গুলিয়ে ফেলে। একটা মানুষ, আর পাঁচটা মানুষ, ঘটনাটা একই। আমার সঙ্গেও ঘটেছে, যার সঙ্গে আমার কোনোদিন কোনো ব্যক্তিগত সমস্যা হয়নি, কথাকাটাকাটি হয়নি, তবুও সে আমার কাজকে কখনও সাপোর্ট তো করেইনি, বরং কতটা খারাপ বলা যায় সেই চেষ্টা করেছে। গঠনমূলক সমালোচনা বা আলোচনার কোনো জায়গাই নেই। আমি একটা জিনিস বুঝেছি, তোমার কাজের মান যত বাড়বে, নেগেটিভ ফলোয়ারের সংখ্যাও ততই বাড়বে।
Discussion about this post