কথায় আছে “বারো মাসে তেরো পার্বণ।” কিন্তু এই ছোট্ট শহর সোনামুখীতে হয় বারো মাসে আঠারো পার্বণ। তাই হয়তো সোনামুখীর আর এক নাম গুপ্ত বৃন্দাবন। কালী-কার্তিক পুজোর পাশাপাশি সোনামুখীর আর এক ঐতিহ্যবাহী উৎসব হল বাবা মনোহর দাসের মহোৎসব। কিন্তু কে এই মনোহর দাস? তিনি কি সোনামুখীর বাসিন্দা? না। প্রচলিত আছে তিনি সোনামুখীর বাসিন্দা না। মহাপ্রভূ শ্রীচৈতন্যদেবের নীলাচলে যাত্রার সময়ে মনোহর দাস দামোদর নদ পেরিয়ে বাঁকুড়ার সোনামুখীতে এসে পৌঁছান। সোনামুখীর শ্যামের মন্দিরে আশ্রয় নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা শুরু করেন। পরে এই স্থানেই তিনি সিদ্ধিলাভ করেন বলে শোনা যায়। স্থানীয় মানুষের কাছে তিনি অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন বলে জানা যায়। এখন যে এলাকা মনোহরতলা, সেখানেই তিনি তালপাতার ছাউনির নীচে থাকতেন। প্রায় দশ বছর সোনামুখীতে তিনি বসবাস করেছিলেন।
একসময় সোনামুখীর তাঁতিরা মহাসঙ্কটের পড়েন। বিশেষ এক ধরনের পোকা তাঁদের তাঁত কেটে নষ্ট করে দিচ্ছিল। তাঁতিরা মনোহর দাসের শরণাপন্ন হন। তাঁর চেষ্টায় সেই সমস্যা থেকে তাঁতিরা মুক্তি পান। শ্রীকৃষ্ণ ও চৈতন্যদেবের ভক্ত আলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন মনোহর দাস। রামনবমীর দিন তিনি সমাধিস্থ হন। সেই সময়কাল থেকে সোনামুখীতে মনোহর দাসের স্মরণে তিন দিনের মহোৎসব হয়ে আসছে। শুরুর সেই সময় থেকে তন্তুবায় সম্প্রদায়ের মানুষ এই মহোৎসবের আয়োজন করে আসছেন।
বাঁকুড়া ছাড়িয়ে রাজ্যের হাজারো বাউল শিল্পীর আগমন ঘটে এই তিন দিনের মহোৎসবে। এর অন্যতম আকর্ষণ হল সাধুসঙ্গ। ১৬ টি আখড়ায় বাউল গানের পাশাপাশি মূল আকর্ষণ হল মনোহর দাসের মন্দিরে ‘ভাত কাড়াকাড়ি’। কয়েকটি নতুন মাটির হাঁড়ি পাশাপাশি রেখে অন্নভোগ রান্না হয়। সেই অন্নভোগ সংগ্রহের জন্য অসংখ্য ভক্ত ভিড় জমান। ভক্তরা বিশ্বাস করেন, মনোহর দাসের এই মোচ্ছবের ‘ভাত’ সংগ্রহ করে রেখে কোনো বিশেষ দিন বা বিশেষ কাজের আগে ভক্তি ভরে সেই ভাত মহাপ্রসাদ হিসাবে গ্রহণ করলে সমস্ত কাজে সিদ্ধিলাভ হয় ও রোগমুক্তি ঘটে।
এই উৎসবকে কেন্দ্র করে এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে উচ্ছ্বাস চোখে পড়ার মতো । তিন দিন ধরে বিভিন্ন আখড়ায় সাধু ও নরনারায়ণ সেবা হয়ে থাকে। কথিত আছে মনোহর দাসের মন্দিরে মানত করলে সেই মনস্কামনা বিফলে যায় না। তাই দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা ভিড় জমান তাদের মনস্কামনা পূরণের জন্য। এছাড়াও এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বসে যায় ছোটখাট মেলা। সবমিলিয়ে এই মহোৎসবকে কেন্দ্র করে এই তিনদিন আনন্দে মেতে ওঠে সোনামুখীবাসী।
Discussion about this post