পয়লা বৈশাখ নিয়ে বাঙালির উন্মাদনা কোনও নতুন বিষয় নয়। এই উৎসব আসলে বাঙালির একান্ত জাতিসত্ত্বার অনুভব। যাবতীয় জীর্ণ, পুরনো, অসুন্দর, অশুভকে পিছনে ফেলে নতুনের কেতন উড়িয়ে বর্ষবরণের দিন একথা স্বয়ং রবিঠাকুর বলে গিয়েছেন। আর এই অনুভব থেকেই রচিত হয়েছে কত শত লেখা, পূর্ণ হয়েছে বইয়ের পাতা, তৃপ্ত হয়েছে বাঙালির সদা পিপাসু মন।
বাঙালির পেটপুজোর সাথে পাল্লা দিয়ে চলে এসেছে কলমপুজোও। বই প্রিয় বাঙালির বৈশাখী আনন্দে বইয়ের ভূমিকা তাই অনিবার্য। এই দিনটির বাঙালি পঞ্জিকার সাথে কোনও শুভ যোগ সেই অর্থে নেই। তাতে ক্ষতি নেই। আবেগপ্রিয় বাঙালি নিজের পছন্দের সবকিছু অবলীলায় জুড়ে দিয়েছে এই উৎসবের সুতোয়। বই প্রকাশও বাদ যায় কেন! অতীতে বাংলা বইয়ের প্রকাশ ঘিরে চরম উদ্দীপনা থাকতো এই বৈশাখেই। পয়লা বৈশাখ সাক্ষী থেকেছে পাঠক-প্রকাশকের মধ্যেকার শত শত বইয়ের চুক্তির। সারা বছরের লেখা শেষে সদ্যজাত বই উঠে আসতো বইপাড়ার পুরনো র্যাকে। কলেজ স্ট্রিটের সরু গলিগুলো ভরে থাকতো নতুন বইয়ের আঠার গন্ধে। কোনও অর্ধপক্ক বইয়ের দিকে হাত বাড়ালেই দোকানি রে রে করে উঠতো, নতুন বইয়ের কাঁচা আঠার বাঁধুনি, হাত দেবেন না প্লিজ, ও বই এখনও পাকেনি!
সেকালে বই পাড়ায় পয়লা বৈশাখ যাপন এক মহোৎসবের রূপ নিত। প্রায় প্রত্যেক প্রকাশন সংস্থা ওইদিন প্রকাশ করতো নতুন বই। আর গ্রাম শহর নির্বিশেষে লেখক, পাঠক ভিড় জমাতো সেই আনন্দ আসরে। বইদের জন্মলগ্ন চাক্ষুস করার শিশুসুলভ আনন্দ টের পাওয়া যেত জন্মদাতাদের চলনে-কথনে। প্রতিটি লেখক সেদিন সদ্য ভূমিষ্ট বইশিশুর গর্বিত পিতা। লেখকদের হাতে প্রকাশনী সংস্থা সেদিনই তুলে দিত পারিশ্রমিকের অর্থ। বৈশাখের খররৌদ্র মাথায় নিয়েও চওড়া হাসি লেগে থাকতো লেখক সহ পাঠক ও প্রকাশনী সংস্থাগুলির মুখে। কলেজ স্ট্রিটের রাস্তা তখন বাঙালির পাট ভাঙ্গা সাদা ধুতি পাঞ্জাবি আর শাড়িতে সজ্জিত এক একজন তাবড় লেখকের চাঁদের হাট। লেখক, পাঠক, ছাপাখানার কর্মচারী, বাধাইয়ের জন্য মিষ্টি , ঠান্ডা পানীয়ের অঢেল ব্যবস্থা সব নিয়ে বই পাড়ায় নেমে আসতো এক অন্য নববর্ষ।
হাজার হাজার বইয়ের জন্ম লগ্নে এভাবেই সাক্ষী থেকেছে বই পাড়া আর পয়লা বৈশাখ। যা গিয়েছে, তাই অতীত একথা আর খাটে না। বর্তমানে বই প্রকাশের যাবতীয় উন্মাদনা বইমেলা কেন্দ্রিক হয়েছে ঠিকই, তবে তাতে ভাঁটা পড়েনি কলেজ স্ট্রিটের বৈশাখী বইমেলায়। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে এই কলকাতার বুকেই শুরু হয়েছিল বইয়ের মেলা, যার পোশাকি নাম বই উৎসব। উপরি পাওনা ছিল বইয়ের উপর বিশেষ ছাড়ের সুবিধা। বলা বাহুল্য, এই উৎসব আজও সগৌরবে বিদ্যমান।
Discussion about this post