বিবেকানন্দ বলেছিলেন ‘জন্মেছিস, তো দাগ রেখে যা’। কিন্তু উনিশ শতকের নারীর পক্ষে এই ‘দাগ’ রেখে যাওয়া কতখানি কঠিন ছিল, তা আমরা সেই সময়ের সমাজ, রাজনীতি জানলেই বুঝতে পারব। তবু, শত প্রতিকূলতার মধ্যেই আমরা উনিশ শতকের বহু নারীর নাম পাই যানরা সমাজের রীতিনীতির উলটো দিকে হেঁটে নিজেদের ছাপ রেখে গেছেন। তাঁদের মধ্যেই অন্যতম হলেন শ্যামমোহিনী দেবী। তাঁর আত্মবিশ্বাস, অফুরন্ত কর্মক্ষমতা সেই সময়ের সমাজের নারীদের প্রেরণা জুগিয়েছিল।
শ্যামমোহিনী দেবীর জন্মের সময়টিই যেন ছিল প্রচলিত কুসংস্কার আর প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সময়। সেই সময় সন্তান প্রসব করবেন, বা করেছেন এমন নারীকে আলাদা রাখা হত। সেইমত শ্যামমোহিনী দেবীর মা-কেও আলাদা রাখা হয়েছিল, কিন্তু ঝড়ে আঁতুড় ঘর ভেঙে যাওয়ায় শ্যামমোহিনী দেবীর জন্ম হয়েছিল একেবারে শোবার ঘরের বিছানায়। অর্থাৎ, ময়মনসিংহ জেলার সহবৎপুর গ্রামে ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্মলগ্নটিই ছিল যেন কালবৈশাখীর পূর্বে, সিঁদুরে মেঘ। ওদিকে তাঁর মা গোবিন্দময়ী দেবী সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। তাঁর পিতা নিজেদের বাড়িতেই গরীব ছাত্রদের থাকা-খাওয়া ও পড়াশোনার দেখভাল করতেন।
মায়ের কাছে শ্যামমোহিনী দেবীর পড়াশোনার হাতেখড়ি হয়েছিল। ১৮৯৩ সালে পাঁচ বছর বয়সে তিনি স্কুলে ভর্তি হন। পড়াশোনার ক্ষেত্রে মা ছিলেন শ্যামমোহিনীর প্রেরণা। নয় বছরেও যখন তিনি পড়াশোনা করেছেন, তাঁদের গ্রামে ছি ছি রব ওঠে। কারণ, বিয়ের বদলে শিক্ষিত মা-বাবা মেয়ের শিক্ষার দিকেই নজর রেখেছিলেন। শ্যামমোহিনী উচ্চ প্রাথমিক পরীক্ষায় পুরো রাজসাহী বিভাগে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক পেলেন। পাশের বাড়ির এক বৃদ্ধাকে লেখাপড়া শেখালেন, যাতে তিনি রামায়ণ-মহাভারত নিজে পড়তে পারেন। পরবর্তীকালে তাঁর একটি বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল তিনি শিক্ষিত হওয়ায়। পরে তাঁর বিবাহ হয় ঢাকার মৈত্রবংশের সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে। শ্যামমোহিনী দেবী কলকাতায় ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্ম ট্রেনিং স্কুল থেকে সিনিয়ার ট্রেনিং পাশ করেন। লেডি অবলা বসু তাঁকে নারী শিক্ষা সমিতির বিদ্যালয় পরিদর্শিকার দায়িত্ব দেন। পরে তিনি শিক্ষিকার কাজও করেছেন।
মেয়েদের লাঠি খেলা, যুযুৎসু শেখানোর জন্য ‘দীপালী সংঘ’ প্রতিষ্ঠা করেন শ্যামমোহিনী। তাঁর চেষ্টাতেই ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে পাবনার এম.ই স্কুলটি হাই স্কুলে উন্নীত হয়। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে শ্যামমোহিনী স্কুলের কাজ ছেড়ে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। মহিলা সমিতি গঠন করে চরকা, খদ্দরের প্রচার এবং বিলিতি দ্রব্য বর্জনে মহিলাদের উৎসাহিত করেন। এই সময়ে তিনি ‘তিলক স্বরাজ’ ফান্ডে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দেন। পাবনায় লবণ আইন অমান্য আন্দোলনেও তিনি অংশ নেন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে অনুরূপা দেবীকে সভানেত্রী করে তিনি নিখিল ভারত নারী শিক্ষা পরিষদ গঠন করেন। মেয়েরা যাতে শিক্ষিত, উপার্জনক্ষম ও আত্মনির্ভরশীল হতে পারে সেইদিকেই তাঁর নজর ছিল।
চিত্রঋণ: সুষমা মৈত্র রচিত ‘মহীয়সী শ্যামমোহিনী’ গ্রন্থ







































Discussion about this post