“নদী নতুন শব্দ এখানে: কার যেন ভালোবাসা পুষে রাখে” হয়তো শ্রীমতীও তার বুকে আগলে রেখেছে তার প্রেমকে এখনও।কালিয়াগঞ্জের সেই ছোট্টো নদী শ্রীমতি আজ সে ধুঁকছে। পলি জমেছে তার বুকে। হয়তো সে এখন ঠিক নদীর মতো নয়, ছোট জলাশয়ের ন্যায় খানিক, তবুও সে বইছে। নীলনদ-হোয়াংহোর মত দৈর্ঘ্য নিয়ে গর্ব, সভ্যতার উত্থান-পতন এসব কোন কাহিনীই তার নেই। কিন্তু তার একটা প্রেম ছিল, সত্যিকারের প্রেম। কবিদের কলম এমন কত প্রেমে যে কালি শূন্য হয়ে যায়!
‘সুজলাং সুফলাং’ এই বাংলা প্রকৃতি দেবীর কল্যাণে ‘নদী মাতৃক’ তকমা পেয়েছে সেই কবেকার কথা। গঙ্গা-যমুনা-পদ্মার মতই শ্রীমতি ও এক নদী। ২৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই নদীর উৎস বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও জেলায়। শেষমেষ মিলিয়েছে কালিয়াগঞ্জে মহানন্দা নদীতে। তবে গল্প আছে এই নদীর সৃষ্টি মানুষের হাতেই অথবা হতে পারে প্রেম থেকেই সৃষ্টি এই নদীর। গল্পের নায়ক এক রাজকুমার, নায়িকা অধুনা বাংলাদেশের এক নর্তকী শ্রীমতি। রাজকুমারের পরিচয় চাপা পড়েছে সময়ে।কেউই ঠিক মনে করতে পারেন না তার আসল নাম। তবে সে নায়ক, নায়কের মতোই এখনও উজ্জ্বল। আর শ্রীমতির রূপও যেন প্রকৃতির নিজের হাতে গড়া। সেই রূপে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়েছে বহু মানুষই। স্বয়ং রাজকুমারও বাঁধা পড়লেন সেই রূপে।প্রেমের ইঙ্গিতে সায় দিল অপরপক্ষও। রাজকুমার কথা দিলেন তিনি আসবেন শ্রীমতির কাছে। দেখা করবেন নিয়মিত। তবে বাধা একটিই। পথটি বড়ই দুর্গম। তিনি তো রাজকুমার। এই তুচ্ছ কারণে তিনি থামার পাত্র নন। উপায় বের করলেন, এক ভিন্ন পথের। শ্রীমতীর বাড়ি যেখানে ,সেখানে আছে এক বড়ো বিল। সেখান থেকেই কাটা হবে খাল মহানন্দা পর্যন্ত। যেমন কথা তেমনি কাজ। তৈরি করা হলো সম্পূর্ণ এক নদী। নদীপথে শুরু হলো তাদের নতুন এক যাত্রা।
কিছুদিনের মধ্যেই রাজকুমার শ্রীমতিকে বিয়ে করলেন মহাকাল মন্দিরে। নৌকাপথে রওনা হলেন রাজকুমারের প্রাসাদে। বিবাহ সম্পন্ন তাদের। শেষটা সুন্দর হতে পারতো এভাবেই। কিন্তু শেষ হয়নি।পুত্রবধু সে কিনা নর্তকী! এ কল্পনার বহির্ভূত রাজামশাইয়ের। নৌকা থেকে ফেলে দিলেন শ্রীমতিকে, তার স্বামীর কাটা খালেই। রাজকুমারকে বন্দি করে রাখা হল।যে খালে তাদের দীর্ঘদিনের অপেক্ষা অবসান হয়েছিল, সেই খালেই শেষ হলো শ্রীমতীর জীবন। ঘটনার পর সময় এগলো নিজের মতোই। রাজকুমারও একদিন তার পিতার সিংহাসনে বসলেন। তবে ভোলেননি তার অসম্পূর্ণ প্রেমকে, তার প্রেমিকা তথা স্ত্রীকে। সেই নদীর নাম রাখলেন’শ্রীমতী’। বড়ো ভালোবেসে, যন্ত্রণায়, আবেগে দেওয়া সে নাম। সে কাহিনী কি উবে যাওয়া এতই সহজ! শ্রীমতি তার গ্লানি নিয়ে নিয়ে বয়ে চলেছে এখনও। তবে ভরা যৌবন পেরিয়েছে সে এখন। মানুষ ধান বুনছে তার পলিতে। কেউ কেউ ব্যবহার করছে তাকে নিজস্ব সম্পত্তি ন্যায়। প্রশাসনের কাছে শ্রীমতী সংস্কারের দাবি জানিয়েছে জনগণ । এই নদীতে এক সময় পারাপার হত বণিকদের বড় বড় নৌকা, আজ তার কিনা এই হাল! কত সংস্কৃতি, কত গল্প গড়ে উঠেছে তার পাড়ে। হয়তো কান পাতলে শোনা যাবে এমন অনেক নদীর গল্প। জীবনানন্দের কলম যাকে প্রশ্ন করেছিলো,”নদী, তুমি কোন কথা কও?”
Discussion about this post