আন্দামান নিকোবরের গভীর বনভূমি ও অভ্যন্তরীণ অরণ্য। এখানেই শম্পেন উপজাতির জীবন উপত্যকা ও গুহাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। জানা গেছে, উন্নয়নের জন্য এখানে নাকি তৈরি হবে মেগা-টাউনশিপ, গভীর সমুদ্র বন্দর, বিমানবন্দর এবং পর্যটন হাব। এই প্রকল্পে প্রায় ১৩০ বর্গকিলোমিটার বনভূমি ধ্বংস হবে, কাটা হবে এক মিলিয়নেরও বেশি গাছ। আন্দামানের এই অঞ্চল ভারতবর্ষের অন্যতম ‘ইকোলজিক্যাল হটস্পট’, সেখান থেকে নিশ্চিহ্ন হবে জীব বৈচিত্র্য ! এই প্রকৃতি ধ্বংস এবং বিপর্যয়ের দৃষ্টান্ত এর আগে আমরা বহু জায়গায় দেখেছি, সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের ভয়াবহ বন্যাও এর বাইরে নয়, এরপর আরও কোন বিপর্যয় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য, সেটাই দেখার!
শম্পেন উপজাতি, যাদের বর্তমান জনসংখ্যা মাত্র ২২৯ জন। এদের জীবনযাপন মূলত এই দ্বীপের অন্তর্গত অরণ্য ও নদীকে ঘিরে। আধুনিক সভ্যতার সংস্পর্শে আসা মানে তাদের জন্য রোগব্যাধি, সাংস্কৃতিক ক্ষয়, মৃত্যু। ঠিক যেমন কিছুটা হয়েছিল জাড়োয়াদের সঙ্গে। এখন তো চিড়িয়াখানা দেখতে যাওয়ার মত মানুষ জাড়োয়া দেখতে যায় আন্দামান। মানুষের প্রতি, জীবনের প্রতি, উপজাতির ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রতি বিন্দুমাত্র সম্মান বা সহানুভূতি কর্তৃপক্ষের নেই, ফলে সাধারণ মানুষও সচেতন নয়। এই প্রকল্পের কারণে তাই নিকোবরি জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ হাজার মানুষ তাদের ঘর হারানোর আশঙ্কায়। প্রকল্পের কাজ শুরু হলে বনাঞ্চল উজাড় হবে, জলধারা বদলে যাবে, আর মানুষকে শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করবে তথাকথিত উন্নয়নের চাকা।
প্রকল্পটি শুরু থেকেই অবশ্য আইনগত ও নীতিগত বিতর্কের মধ্যে রয়েছে। পূর্বে এই দ্বীপের উপকূলীয় অংশকে ‘CRZ-1A’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল, যা পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল এবং যেখানে বড় ধরনের নির্মাণ নিষিদ্ধ। পরবর্তীতে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে সেটি ‘CRZ-1B’ তে রূপান্তরিত করা হয়, যাতে বন্দর ও টাউনশিপ গড়ে তোলা যায়। উচ্চ পর্যায়ের কমিটি ও ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল (NGT)- এর পর্যবেক্ষণ সত্ত্বেও এই ধরণের ছাড়পত্র মঞ্জুর হয়েছে, যা দেশের পরিবেশনীতি ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতার ওপর বড় প্রশ্ন তোলে।
তবুও কিছু মানুষ লড়ছে। পরিবেশ কর্মী, মানবাধিকার সংস্থা এবং আদিবাসী অধিকারবাদীরা। তাঁরা এই প্রকল্পকে “ইকোসাইড” বলছেন, অর্থাৎ সচেতনভাবে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের একটি রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া। লেদারব্যাক কচ্ছপ, সাল্টওয়াটার কুমির, প্রবালপ্রাচীর ও নানা বিরল প্রজাতির প্রাণীর বসবাস এই অঞ্চলে। ন্যাশনাল গ্রীন ট্রাইবুনালে মামলা চলছে, আন্তর্জাতিক সংস্থা উদ্বেগ জানিয়েছে, কিন্তু মূলধারার রাজনীতি ও সংবাদমাধ্যম নীরব। কেন্দ্র সরকার বলছে, এটি জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের অংশ। কিন্তু এই উন্নয়ন তো জীববৈচিত্র্যের বিনিময়ে, এই উন্নয়ন তবে কাদের জন্য? পরে ইতিহাস হয়ত বলবে, আন্দামানের অরণ্যে একদিন মানুষ ও প্রকৃতির সহাবস্থান ছিল, যা উন্নয়নের নকশায় হারিয়ে গেছে নিঃশব্দে।
Discussion about this post