বাংলার ইতিউতি লুকিয়ে আছে বনেদি দুর্গা পুজোর নানান ইতিহাস। বনেদি পুজো মানেই পুরনো ঐতিহ্যের বাহার। ইদানিং থিমের ভিড়ে ঢাকা পড়েছে বনেদি বাড়ির দুর্গা পুজো। তবু আজও বনেদি বাড়ির প্রাচীন ঐতিহ্যময় ইতিহাসগুলিকে বাঁচিয়ে রেখেছে বিভিন্ন পরিবারের বংশধরেরা। বনেদি বাড়ির ঠাকুর দালানে কখনও তিনি মহিষাসুরদলনী আবার কখনও তিনি অভয়দায়িনী। দেবীর অভয়া রূপের কথা বললে প্রথমেই হাওড়ার যে বনেদি বাড়ির নাম মাথায় আসে তা হল শিবপুরের পাল বাড়ির কথা। চলুন জেনে নিই প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাল বাড়ির পুজোর বনেদিয়ানার কথা।
প্রতিটি বনেদি বাড়ির দুর্গা পুজোর আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। পালবাড়ির দুর্গা পুজো অন্যান্য বনেদি বাড়িগুলির থেকে অনেকটাই আলাদা। এখানে মা ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ রূপে নয় পূজিত হন ‘অভয়া’ রূপে। দশভূজার বদলে দ্বিভূজা হিসেবেই দেখা যায় মা’কে। অর্থাৎ একহাতে সকলকে অভয় দান করছেন এবং আর এক হাতে ফোটা পদ্মফুল ও একটি ফল। এই পুজো শুরু হয়েছিল পালবাড়ির আদিপুরুষ স্বর্গীয় সর্বস্য পাল মহাশয়ের হাত ধরেই। একদিন হঠাৎ করেই স্বপ্নাদেশ পান এই পুজো শুরু করার। ব্যাস! তারপর থেকেই শুরু হয় এই পুজো । তবে এই বাড়ির দুর্গাপুজো সবচেয়ে বেশি খ্যাতিমান ও জৌলুস লাভ করেছে ওই বংশেরই সন্তান এককালের ভারত বিখ্যাত ওষুধ প্রস্তুতকারক ও বিক্রেতা বটকৃষ্ণ পালের আমলে।
রথযাত্রার দিন পালবাড়ির ঠাকুর দালানে বহু শতাব্দী প্রাচীন দেবী দুর্গার কাঠামোটিকে পুজোর মাধ্যমে শুরু হয়ে যায় মূর্তি গড়ার কাজ । ডাকের সাজে ধীরে ধীরে সুশোভিত হতে থাকে মায়ের মূর্তিটি। সে কী সাজসজ্জা! উৎসবের আবহে মেতে ওঠে বহু শতকের এই প্রাচীন বনেদি বাড়ি। দেবীর আরাধনার পাশাপাশি বোধনের দিন থেকে নবমী পর্যন্ত টানা ১৫ দিন ধরে চলে চণ্ডীপাঠ। পাল বাড়ির পুজোর এরকমই বিশেষ কিছু বৈচিত্র্য রয়েছে। অন্নভোগের বদলে লুচি, মিষ্টি, ফলের মাধ্যমেই ভোগ দেওয়া হয় দেবীকে। সপ্তমীর দিন বাড়ির ঠাকুর দালানেই নবপত্রিকার স্নান করানো হয়। রীতিমতো সাড়ম্বরের সঙ্গে পুজোর তিন দিন অর্থাৎ সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে পাঠাবলি, ফলবলি এবং মোষ বলিও হয় পাল বাড়িতে। প্রথা অনুযায়ী বাড়ির গৃহিণীদের অনুপস্থিতিতে সন্ধিপুজো সম্পন্ন করেন বাড়ির ছেলেরাই। আগে কামান শব্দ শুনে তারপরই শুভারম্ভ হত এই সন্ধিপুজোর।
আর পাঁচটা বাড়ির সাথে নিয়মের নানান বৈচিত্র্য রয়েছে পাল বাড়ির সিঁদুর খেলাতেও। এখানে দশমীর সকালে বরণের আগেই ঠাকুরকে সিঁদুর ছুঁইয়ে বাড়ির মহিলারা মেতে ওঠেন সিঁদুর খেলায়। রক্তিম আভায় ঢেকে যায় চারপাশ। বহুবছর আগে মাকে কাঁধে করে নিয়ে বাড়ির ছেলেরা গঙ্গায় নিয়ে আসতেন বিসর্জনের জন্য। তবে এখন লোকবলের অভাবে ট্রাকেই নিরঞ্জনের পথে নিয়ে যাওয়া হয় পাল বাড়ির দুর্গা প্রতিমাকে। থিমের বেড়াজাল পেরিয়ে বনেদি বাড়ির পুজোর স্বাদ নিতে আসতেই পারেন শিবপুরের শতাব্দী পেরোনো পাল বাড়ির এই পুজোয়। আসবেন কীভাবে? মন্দিরতলা বাস স্টপে নেবে টোটো বা রিক্সায় চেপে তাকে পাল বাড়িতে নিয়ে যেতে বলুন। অবশ্য পায়ে হেঁটেও নবগোপাল মুখার্জী লেনের পাল বাড়ি মাত্র মিনিট দশেকের রাস্তা।
Discussion about this post