একজন লেখক শাপলা সপর্যিতা নাকি একজন মা শাপলা সপর্যিতা? কোনটি বেশি চ্যালেঞ্জিং?
লেখক শাপলা সপর্যিতার চেয়ে একজন মা শাপলা সপর্যিতার চ্যালেঞ্জটাই বড়। কারণ আমি সংসার ছেড়েছিলাম আমার মাতৃত্বের দায়িত্ব ও বোধ থেকে। যে কারণে যে কোনো মূল্যে মায়ের দায়িত্ব পালনে ও কর্তব্যে আমি বদ্ধপরিকর। অথচ লেখক শাপলা সপর্যিতার কোনো পরিকল্পনা নেই। মনের আনন্দে লিখি। যাতনায় কিংবা দুঃখে লিখি, জবাব লিখি। এটা ক্ষণিক সময়ের বিষয় আর আমার একার। লিখলে লিখলাম না লিখলে নয়। বই হলে হবে না হলে নয়। খুব একটা আসে যায় না তাতে। কিন্তু মা শাপলা সপর্যিতা করলে করলাম না করলে নয় এমন জায়গায় নেই। তাকে বাঁচতেই হবে, বাঁচাতেই হবে। তাতে তার যা যা করণীয় অথবা করণীয়র চেয়েও অধিক তা করতেই হবে।
আপনার লেখায় বহুমুখীনতা লক্ষ্য করা যায়। কোনও নির্দিষ্ট লেখকের প্রভাবান্বিত বলে আপনাকে চিহ্নিত করা যায় না। তারপরেও একজন লেখক মাত্রই কোনও একজনের লেখা ভালবাসেন বা আদর্শ মানেন। লেখালেখির জগতে আপনার সেরকম অনুপ্রেরণা বা আদর্শ কে?
লেখালেখির জগতে আমার কোনো অনুপ্রেরণা নেই আদর্শ তো দূরে। সত্যিই আমি কোনো লেখকের দ্বারা প্রভাবান্বিত নই। আর সত্যি কথা বলতে আমি আগেও বলেছি আমার লেখার শুরু তখন যখন আমি বয়সেরও আগে আগে অনেক ভারী ভারী বই অর্থাৎ উপন্যাস পড়ে ফেলেছিলাম। মনের ভেতর গভীর এক বেদনা যখন থেকে আমাকে আকড়ে ধরেছিল কোনোদিন ছেড়ে যাবে না এই শপথে। যে কারণে আমার ভেতর কেবল নানা বোধ কাজ করেছে। জীবন জগৎ মানুষ মন এসব। কিন্তু লেখার ধারা বা বৈশিষ্ট্য নিয়ে তখন ভাবনা ছিল না। তারপর বহু বছর লেখাপড়া থেকেও দূরে চলে গেলাম। যখন বিশাল ফাঁকা আর শূন্য একটা জায়গা থেকে শুরু করলাম তখন আমি একা। এটি একটি সুবিধে হয়েছে অবশ্যই। কারণ তাতে আমি কারো প্রভাবাধীন না থেকে একেবোরে নিজেই মতো করে ভাবতে ও লিখতে পারলাম। নিজের একটা সিগনেচার তৈরীর চেষ্টা করলাম।
আমার লেখায় বহুমুখীনতা লক্ষ্যণীয় কথাটি ঠিক বলেছেন। আমি যুগ ধর্ম চলমান প্রথা গুরু কিংবা চর্চার বাইরে অবস্থান করে লিখি। কোনো লেখা শুরু করার আগে কোনো ভাবনা থাকে না। শুরুর পর আমার মন মগজ আর বোধ যেদিকে আমাকে পরিচালিত করে আমি সেদিনেই সর্বোচ্চ সততায় লিখতে শুরু করি। তাতে যে অনুভবটুকু যে ভাষায় যে শব্দে গভীর থেকে উচ্চারিত হয় সেভাবেই তা লেখা হয়। ভাবনা প্রকাশে আমার প্রতিবন্ধকতা কম। তার কারণ আমার প্রতিবেশ আমার যাপিত জীবনের ধারা। হয়তো প্রচুর প্রচুর উপন্যাস ৭ থেকে ২০ বছর বয়সের ভেতর পড়ে ফেলেছিলাম বলে আমার শব্দসম্ভারও খুব ঐশ্বর্যশালী। যা ওই বয়সে না পড়ে আজ পড়লে হতো না। তখন অবচেতনে বা অজান্তেই যা যা আমার ভেতর অবস্থান তৈরি করেছে তা আজ প্রকাশে সর্বাত্মক সহায়ক হয়ে ওঠে। আমি মনে করি লেখকের ভাবনার প্রকাশে যা শক্তির যোগান দেয়। পড়ালেখায় দীর্ঘ গ্যাপের কারণে আমি একটা ফাঁকা অর্থাৎ শূন্য জায়গা পেয়েছি যেখান থেকে আসলে প্রভাবমুক্ত থেকে শুরু করা যায়। যে কোনো দিকে যাওয়া যায়। অতীত ও বর্তমানের মাঝখানে একটি ফাঁকা জায়গা। বহুমুখীনতা হয়তো সে কারণেই।
বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ কি দিন দিন কমছে? সাহিত্যচর্চা ক্রমশঃ সোশ্যাল মিডিয়ার গণ্ডিতেই কি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে?
একদম নয়। বইয়ের প্রতি আগ্রহ কমছে আমি অন্ততঃ বলতে পারি না। এমনকি আমি নিজে অনলাইনে লিখি কিন্তু পড়ার জন্য বইকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিই। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে বহু লেখক পাঠককে আমি জানি যারা প্রচুর বই কিনে পড়েন। কলকাতায়ও অনেক অল্প বয়সী পাঠককেও দেখেছি বই পড়ে। সেদিন সিলেটে গিয়েও কিছু লেখক কবির সাথে পরিচিত হলাম যারা সাহিত্যচর্চায় ব্রতী সাধক অথচ প্রকাশ্যে কুণ্ঠ। প্রচুর পড়ালেখা ওদের কিন্তু অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবনত। এদেরকে দেখেছি কী পরিমান বই কেনে ও পড়ে। এমনকি আমার সম্প্রতি প্রকাশিত উপন্যাস সম্পর্কটি জৈবিক প্রসঙ্গেও দেখেছি অনেক অগ্রজ শ্রদ্ধেয় অনুজ কিংবা বন্ধু পাঠক যারা নিয়মিত অনলাইনে পড়েছেন, তারাও অপেক্ষা করে আছেন বইটি হাতে নিয়ে পড়বেন করে।
ভারতীয় উপমহাদেশ অনেকটা এগোলেও নারীদের ক্ষেত্রে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পারিবারিক এবং সামাজিক সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে আপনি কীভাবে স্বাধীনচেতা লেখক হয়ে উঠলেন?
উঃ আমি যদি ভেবে নিই ব্যক্তির/নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকেই এখানে আগানো বলা হয়েছে। তা নইলে আমি বলবো আগানো আসলে নারী কিংবা পুরুষের ব্যক্তিগত বিষয় যা পরিপ্রেক্ষিত ঠিক করে দেয়। সেই আরবে, যখন বিবি খাদিজা ঊষর মরুভূমিতে উটের পিঠে বাণিজ্যের সদাই মাল মশলা পাঠাতেন তখনকার যুগটাকে আমরা অন্ধকার যুগ বা আইয়ামে জাহলিয়াতেও যুগ বলি অথচ ভেবে দেখুন তখনকার যুগে একজন নারী ব্যবসা করেছেন। তার অধীনস্ত লোকগুলো বেশিরভাগই পুরুষ যারা তার ব্যবসার বিশ্বস্ত হাত ছিলেন। হাইপেশিয়ার মতো নারী যার বক্তৃতা শুনতে দূর দূর থেকে লোক আসতো। টিকেট কেটে শুনতো। তারও আগে কৃষিকাজ নারীরা করতো, পিঠে সন্তানকে বেঁধে নিয়ে। সে যুগটাকে কোন ঘরানায় ফেলবেন? নারীর সীমাবদ্ধতা আসলে সমাজ রাষ্ট্র ও পুরুষতন্ত্রের সাজানো সুবিধালিপ্সু একটি বিষয়। যেখানে নারীর শরীর অর্থাৎ জন্মগত প্রাপ্তিকেই সুযোগ হিসেবে নেয়া হয়েছে। নারী বরাবরই আগানো। নারীর শক্তি অসীম। তাকে বাধাগ্রস্থ করার চেষ্টাটাই কেবল চিরকালের।
আমার প্রেক্ষিত আলাদা। আমি সামাজিক এবং পারিবারিক প্রথা ভেঙেছি। নারী স্বামী সংসার ছাড়ে না। আমি ফেলে এসেছি। নারী পুরুষের সঙ্গে থাকে, আমি একা থাকি। নারীর ভরণ পোষন পুরুষ করে নারীর সন্তানের ভরণ-পোষণ পুরুষ করে। আমি আমার ভরণ পোষণ করি। আমি আমার এবং মশিউরের সন্তানকে একা লালন পালন ভরণ-পোষণ করি। অত্যাচার মাত্রা অতিক্রম করলে আমিও বেঁচে থাকা এবং সন্তানদের বাঁচানোর জন্য সীমাবদ্ধতাকে আর মেনে নিইনি। একটা শেষ সীমা থাকে যে কোনো কিছুরই। সেটা অতিক্রান্ত হয়ে গেলে তখন আর কোনও সীমাবদ্ধ বলে কিছু থাকে না। যেটাকে সীমার মধ্যে রাখার এত চেষ্টা করেছি তা যখন অতিক্রান্ত হয়েছে তখন আপনিই নারীর ভেতরের এক আদ্যাশক্তি জেগে উঠেছিল। সেই শক্তিই আমাকে চালিত করে। আমার শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা ও বিশ্বাসের সাথে আর এক পরস্থ বেশি যেটার যোগ তা হল লেখা। আমি যখন দেখলাম লেখক শাপলা সপর্যিতাই একটি আইডেন্টিটি হতে পারে তখন আর কোনো আইডেনটিটি কেন লাগবে আমার কন্যাদের জন্য? আর আমার তো কোনো সাইনবোর্ড দরকার নেই। যখন আমি পরিবার কিংবা প্রথা ভাঙলাম তখন আমি আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠলাম সত্য বলতে, অবস্থান, মন ও পরিপ্রেক্ষিত বর্ণনায়। তাতে আমার লেখায় গতি এল। পাঠক খুব সহজে তাদের না বলা কথাগুলো খুঁজে পেল আমার লেখায় আমার জীবনে আমার ভাবনায়, বিশেষ করে নারী। তারা যা করতে চায়, যা বলতে চায় কিন্তু পারে না তার ছবি যখন আমার লেখায় দেখতে পায় পাশাপাশি আমার যাপিত জীবনের সত্যাসত্যরূপ প্রমাণস্বরূপ পেয়ে যায় তখন তাদের কাছে আমি একজন বিশ্বাসী লেখক হয়ে উঠি। তাতেই আমার গতি বাড়ে। আত্মবিশ্বাস প্রতিষ্ঠা হয়। সেই সঙ্গে আমার জন্মগত পরিশ্রমী মানসিকতা আমাকে সাহস দেয়। এভাবেই…
অতি সম্প্রতি মুক্তি পেল আপনার বই ‘মগ্নচৈতন্যের কবি ও কবিতা’। এখনও পর্যন্ত পাঠকদের প্রতিক্রিয়া কী পেলেন?
উঃ বইটি প্রেস থেকে গত শনিবারই (১৬ জানুয়ারি) বের হয়েছে। পাঠকের প্রতিক্রিয়া জানা সম্ভব হতো যদি বইমেলাটি হতো। এখন আপাতত ব্যক্তিগতভাবে কিছু প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। তবে প্রেস থেকে বের হবার আগেই অগ্রিম বিক্রি হয়েছে ছটি বই। এটি আমার জন্য বিশাল অনুপ্রেরণা। আসলে পাঠক তো ভালোবাসে প্রথমে লেখা। তারপর লেখককে। বেশ কিছু লেখায় যখন সে তার ইপ্সিত মনটি পেয়ে যায় তখন বাকি লেখাগুলোও অন্তত স্বাদ পেতে চায়। এ কথাটি এ জন্য বলছি কারণ আমি তো আসলে উপন্যাস লিখছি। গত দুবছর তার আগে আরও দু’বছর অর্থাৎ চারটি বছর ধরে পাঠক আমার কথা সাহিত্য অর্থাৎ মৌলিক লেখা পড়ছেন। আর মগ্নচৈতন্যের কবি ও কবিতা সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অনুভব বর্ণনার গদ্য। এই বইটি যখন আগে আগেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে তখন এটুকু বুঝতে পারছি পাঠকের কাছে আমাকে জানার অর্থাৎ আমার লেখার শক্তিকে টেস্ট করার একটি ইচ্ছে জাগ্রত হয়েছে। অর্থাৎ ভিন্ন ধরণের লেখা আদতে আমি কেমন লিখি সে অনুসন্ধিৎসাও হতে পারে।
শোনা যাচ্ছে আগামী ফেব্রুয়ারিতে ‘হান্ড্রেড ফেসেস অব উইমেন’ উপন্যাসটি মুক্তি পেতে চলেছে। সেই ব্যাপারে কী বলবেন?
উঃ খুব সরল ভাষায় বললে, ব্যক্তির জীবনই উপন্যাস। সে অর্থে আমি ‘হান্ড্রেড ফেসেব অব উইমেন’কে উপন্যাসই বলতে চাই। এখানে ব্যক্তি আমি ভেঙে ভেঙে ভেঙে শত শত নারীর ম্যধ্যে মিশ্রিত কিংবা সংক্রমিত অথবা সঞ্চারিত হয়েছি। আবার এভাবেও বলা যায়, অন্য নারী যে আমারও আগের তিনিও এক থেকে বহুতে সঞ্চালিত। যাপনের পরতে পরতে তার নানা রূপই এর প্রধান। ব্যক্তি তো আর একা নন। তাই বিভিন্নভাবে পুরুষও এখানে এসেছেন। প্রতিটি চরিত্র ও ঘটনা এখানে সত্য। নারীর যন্ত্রণা ও বিষাদ এখানে সত্য। ঘটনার বর্ণনা যতটুকু সম্ভব অবিকল। তবে এখানে পাঠক ‘সম্পর্কটি শুধুই জৈবিক’ উপন্যাস থেকে ভিন্ন স্বর উপলব্ধি করবেন। প্রথমত এটি প্রথম পুরুষে লেখা। দ্বিতীয়ত এর ভাষা ভঙ্গী সাধারণ, সহজ। যা জৈবিকে নয়।
ইতিমধ্যেই আপনার ফেসবুক প্রোফাইলে ঘোষণা করেছেন আপনার নতুন ধারাবাহিক সাহিত্যকেন্দ্রিক কোনও কাজ আসছে। যদিও আপনার পাঠকরা এই নিয়ে অন্ধকারে। আপনি কি আলো দেখাবেন?
আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘হান্ড্রেড ফেসেব অব উইমেন’ যখন লিখতে শুরু করি। তখনই আমি ভেবে রেখেছিলাম তিনটি ভাগে এটি লিখবো এবং সত্য ও অবিকল লিখবো। এটি নিজের কাছে একটি চ্যালেঞ্জ, এই সমাজ প্রথা বৃহৎ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এটি সম্ভব কি না। তারই ধারাবাহিকতায় নতুন সিরিজটি লিখতে শুরু করতে যাচ্ছি। আপাতত এর বেশি বলতে চাইছি না।
আপনার কি মনে হয় যে আমরা এই মুহূর্তে এক ফ্যাসিস্ট সময়ের মধ্য দিয়ে চলেছি। যদি তাই হয়, তাহলে মানুষ অন্ততঃ সাংস্কৃতিকভাবে একজোট হতে পারছে না কেন?
উঃ ব্যক্তির সংক্ষুব্ধতার ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। আসছে। আসবে। সৃষ্টির আদি থেকে দেখেন কবে ফ্যসিজম ছিল না? কোথায় ছিল না? যে যেভাবে অত্যাচারিত হয়েছে সুযোগ ও সময় অনুকূলে এলে সেই প্রতিশোধ নিতে উদ্য়ত হয়েছে। এটা পরিবার থেকে রাষ্ট্রে। মানে আমি বলতে চাইছি ক্ষুদ্র থেকে বৃহতে। দেখবেন যে নারীটি শ্বাশুড়ীর দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছেন তিনি নিজেও শাশুড়ি হয়ে একই অত্যাচার করছেন পুত্রবধূকেও। মাদ্রাসায় যে শিশুটির ওপর দিনের পর দিন যৌন উৎপীড়ন হয়েছে, মাদ্রাসার শিক্ষক হয়ে সেও শিশু ছাত্রদের সেটাই করেছেন। যে রাষ্ট্রনেতার সর্বস্ব হত্যা হয়েছে তার উত্তরাধিকার ক্ষমতায় এলে সেও প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠছে। অত্যাচার কিংবা অসভ্যতা একসময় ব্যক্তির বিচার ক্ষমতাকে হ্রাস করতে করতে শূন্যে পৌঁছে দিচ্ছে। ক্ষমতা যখন এইসব বিচারশক্তিহীনদের হাতে এসে পড়ছে তখনই সেটা মারাত্মকভাবে সাধারণ মানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করছে।
সংস্কৃতি আজ দল আর ধর্ম দিয়ে বিভক্ত। এটি একটি কারণ আমার মতে। আর দ্বিতীয়ত বলতে পারি যে অবদমন একসময় বাধ্যগতভাবে আন্দোলনে রূপ নিত। রাজপথে নেমে আসতো। তা আজ বিভক্ত হয়ে ব্যক্তির একা ক্ষোভ হয়ে পারগেশন হয়ে পড়ছে নানা মাধ্যমে। যে কারণে জোটের শক্তিটা তৈরী হচ্ছে না। বিক্ষোভের আগুন জ্বালতে যে যূথবদ্ধ বেদনার কিংবা যাতনার যোগ তৈরী হয় এক থেকে বহুর সম্মিলনে। সে যাতনা নানা দিকে স্ফূরিত হয়ে পড়ছে একা একাই। তাই যোগটা ঠিক হচ্ছে না। আগুনটা জ্বলে উঠছে না। ব্যক্তির নির্বুদ্ধিতাও অনেকাংশে দায়ী। একসময় যে ব্যক্তি সামনের অবস্থা এই সময়ে বসে ভাবতে বা আঁচ করতে পারতো, আজ সেটা পারছে না। মনে করছে আমি বেঁচে গেছি তো বেশ। কিন্তু এই করাল কোপ যে আগামীকাল তাকেও কোপাবে এর বোধ যেন অন্তর্হিত। দেখুন না, আমাদের শিক্ষক প্রাবন্ধিক কবি হুমায়ুন আজাদ স্যারকে তো চেনেন। মৌলবাদীরা যখন তাকে প্রকাশ্যে বইমেলায় চাপাতির আঘাতে রক্তাক্ত করলো তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগেরই অন্য একজন শিক্ষক সমব্যথী না হয়ে অপরের পক্ষালম্বন করেছিলেন। হুমায়ুন আজাদের পুত্র অনন্য আজাদের লেখায় আরও বিস্তারিত জানতে পারবেন। কিন্তু তার কয়েক বছর পর সে শিক্ষকের সন্তানকেই মৌলবাদীরা হত্যা করেছিল। তাহলে বিষয়টি কি দাঁড়ালো। ব্যক্তি তাৎক্ষণিক নিশ্চয়তায় খুশি। পক্ষালম্বন করেই নিরাপদ বোধ করছে। ভবিষ্যৎ চোখে দেখবার ক্ষমতা রহিত। আসলে কি মেধাশূন্যতাই এর জন্য দায়ী। এ সকলই আমার একান্ত প্রশ্ন ভাবনা ও তার উত্তর খোঁজা ও পাওয়া। যা এতক্ষণ বলেছি।
দুই বাংলা জুড়েই কান পাতলে সাহিত্যকে ঘিরে নানান ‘পলিটিক্স’-এর কথা শোনা যায়। এই ধরনের রাজনীতির শিকার আপনি কখনও হয়েছেন?
উঃ মারাত্মকভাবে হয়েছি, এখনও হচ্ছি। আমার ‘সম্পর্কটি শুধুই জৈবিক’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার ঘোষণা তখন সদ্য এসেছে। একটি পর্বও প্রকাশিত হয়নি তখনই ফেসবুকে নিজের টাইমলাইনে একজন নারী কবি লিখলেন ‘সম্পাদকের সাথে প্রেমের কারণে ‘জৈবিক সম্পর্কের’ উপন্যাস প্রকাশিত হতে চলেছে। উপন্যাসটি চলার মাঝামাঝি এক অগ্রজ ও প্রতিষ্ঠিত নারী লেখক নিজের টাইমলাইনে লিখলেন “আমার মতো প্রতিষ্ঠিত সুপরিচিত লেখকের লেখা প্রকাশ না করে অপরিচিত অনামা অখ্যাত লেখকের (হতে পারে তিনি খুব মেধাবী) লেখা কেন প্রকাশিত হবে?” আর তারও কিছুদিন পর উপন্যাসের মন্তব্যে একটি ছোট কাগজের সম্পাদক লিখলেন, “ব্যক্তিগত ও গোপন সম্পর্কের কারণে উপন্যাসটি দিনের পর দিন প্রকাশিত হয়ে চলেছে।” ‘জৈবিক’ শব্দটির বিশদে অর্থ জানেন না তখনও এমন কিছু গল্পকার লিখলেন নামটি পছন্দ হয়নি। কেউ কেউ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন যে এ প্ল্যাটফর্মেই উপন্যাস নিয়ে আরও কথা তিনি বলবেন। কিন্তু পরবর্তী দুই বছরের প্রকাশিত ৮৮টি পর্বে তিনি একটি মন্তব্যও করলেন না। এ সবই সরাসরি এবং উন্মুক্ত। সরাসরি অনেক অগ্রজ অনুজ লেখক কবি প্রকাশক পড়েছেন এসব মন্তব্য এবং নির্লজ্জ মতামত দিয়েছেন। যার একটিও উপন্যাসটির গুণ বা দোষ পর্যালোচনা করে নয়। যারা কেউ উপন্যাসটির গুণ বা দোষ বিচার করলেন না। কিন্তু একে আমি শিকার না বলে উৎসব বলতে চাই। যে উৎসবে আলোটাকেই আমি কেবল নিয়েছি, ছাইগুলো ওদের মুখেই থাক।
অতিমারী সময়ের পর দীর্ঘ লকডাউন, তারপর এখনও পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। লকডাউনের আগে এবং পরে সাহিত্যচর্চাকে ঘিরে ঠিক কতটা বদল ধরা পড়েছে আপনার চোখে?
উঃ সাহিত্য চর্চার বদলটা তো এখনই এক মুহূর্তে বোঝা সম্ভব নয়। ব্যক্তিগত আলোচনায় দেখেছি অনিশ্চিত অবস্থায় যা যা করা যায় না তেমনই অস্থির অবস্থা কবি বা সাহিত্যিকেরও মনে। সাহিত্যিক তো আর সমাজ কিংবা পরিস্থিতির বাইরের কেউ নন! তাছাড়া আমাদের বাংলাদেশে বইমেলাকে ঘিরে বা সামনে রেখে লেখার যে একটা গতি থাকে তা হ্রাস পেয়েছেই। তবে এসব তো আর সাহিত্য চর্চা নয়। সাহিত্য চর্চা হচ্ছে এক ধরণের মেডিটেশন। নামাজের মতো সাধনা। যা শুরু করলে অনেক কিছু ভুলে থাকা যায়, ভুলে যায়। এ হলে তো অতিমারী বা লকডাউন এসব কিছুই নয়। ‘দ্য প্লেগ’ লেখা হয়েছিল কোন সময় মনে করুন। আমি তো এই দীর্ঘ লকডাউনেই ‘জৈবিক’ বন্ধ না করে প্রতি সপ্তাহে একটি করে লিখেই শেষ করেছি।
Discussion about this post