হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। ‘হ্যানা’ বাড়ি, হানাবাড়ি নয়। কিন্তু বাড়িটির যা অবস্থা তাতে হানাবাড়ি মনে হলেও হতে পারে। তবে হানাবাড়ির মতন দেখতে বলেই যে ভুতপ্রেতের বৈঠকখানা হবে এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। শ্রীরামপুরে এমন অনেক জীর্ণ ভাঙা চোরা পুরনো বাড়ি রয়েছে। কিন্তু যে বাড়িটি নিয়ে এই আলোচনা সেটি একটু আলাদা। এর নাম ‘Hannah House’ (হ্যানা হাউস)। বাড়ির নামকরণ হয়েছে হ্যানা মার্শম্যান-এর নামে। বাড়িটির বয়স ২০০ বছরেরও বেশি। শ্রীরামপুর মিশন গালর্স হাইস্কুলের মাঠে অবস্থিত পুরোনো পরিত্যক্ত বিপদজনক অবস্থার একটি বাড়ি। স্কুলের একপাশে জুবুথুবু হয়ে চুপচাপ পড়ে আছে। ইতিহাসও বাড়িটির প্রতি নীরব দর্শক হয়ে তাকিয়ে, কিন্তু বাড়িটি যে দুই শতাব্দীর বিস্তর পরিবর্তনের সাক্ষী তা খুব কম লোকেই জানেন।
১৮০০ সালের ১০ জানুয়ারি দিনেমার উপনিবেশ ফ্রেডরিকস নগরে ‘শ্রীরামপুর মিশন’-এর গঠন হয়। সৃষ্টিকর্তা ছিলেন ‘শ্রীরামপুর ত্রয়ী’ উইলিয়াম কেরি, জোশুয়া মার্শম্যান এবং উইলিয়াম ওয়ার্ড। যদিও পুরুষতান্ত্রিক ‘His-story’ অনককেই ভুলিয়ে দিয়েছে এক সৃষ্টিকর্তীর নাম। তিনি হ্যানা মার্শম্যান, জোশুয়া মার্শম্যানের স্ত্রী। ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা খ্রিস্টান মিশনারি। স্বামীর সঙ্গে বিলেত থেকে তাঁরও ভারতে আসা। শ্রীরামপুর কলেজে তাঁর জন্যেও একটি চেয়ার বরাদ্দ ছিল যা বর্তমানে শ্রীরামপুর কলেজের কেরি সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত রয়েছে। শ্রীরামপুর সহ সমগ্র বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে তাঁর অবদানও কম ছিল না, বিশেষ করে নারী শিক্ষায়।
১৮০০ সালের মে মাসে শ্রীরামপুরে দুটি বোর্ডিং স্কুল চালু করেন মার্শম্যান দম্পতি। এগুলি মূলতঃ ছিল সাহেব অথবা অ্যাঙ্গলো-ইন্ডিয়ানদের জন্য। ওই বছরেই তারা স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য দুটি স্কুল খুলতে উদ্যত হয়েছিলেন। কিন্তু মেয়েরা আবার স্কুলে যাবে? পড়াশোনা করবে? তাও আবার ফিরিঙ্গিদের স্কুলে? রাম! রাম! রাম! স্কুল শুরুর মুহূর্তেই প্রবল সামাজিক বাধার মুখে পড়ায় তা বন্ধ হয়ে যায়। হ্যানা মার্শম্যান হাল ছেড়ে দেননি, তিনি চেষ্টা করতে থাকেন। তবে সমস্যা হলো সেই আমলের কোম্পানি সরকার এইসব বিষয়ে ততটা আগ্রহী ছিল না বরং বিরক্ত হত। এমন সময় ১৮১৩ সালে এলো নতুন চার্টার আইন, যাতে ভারতবর্ষে মিশনারিদের পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে অনুমতি দেওয়া হয়। ১৮১৮ সালে হুগলীর শ্রীরামপুরে হ্যানা মার্শম্যান স্থাপন করলেন প্রথম বালিকা বিদ্যালয়। ১৮১৮-২৮ সালের মধ্যে মার্শম্যান দম্পতির তত্ত্বাবধানে উত্তর মধ্য ভারতের বিভিন্ন স্থানে ৩৩ টি নতুন স্কুল গড়ে উঠেছিল। শুধু শ্রীরামপুরেই তাদের ১২-১৩টি স্কুল ছিল। তবে অধিকাংশ বিদ্যালয়ই বসত কখনো গাছতলায়, কখনো মিশনারিদের ঘনিষ্ট কারোর বাড়িতে, কখনো অস্থায়ী খড় মাটির বাড়িতে। তাই বর্তমানে এই বিদ্যালয়গুলির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। তবে বিদ্যালয়গুলিতে প্রতি বছর পরীক্ষা হত। যে সমস্ত ছাত্রী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হত তাদেরকে চার আনা, দুই আনা করে পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। ১৮২৫ সালের ৯ই এপ্রিলে প্রকাশিত ‘খ্রিস্টান রেজিস্টার’ নামক এক আমেরিকান সংবাদপত্রে শ্রীরামপুর মিশনারিদের বিদ্যালয় পরিচালনা ও তৎকালীন সমাজ সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে।
সর্বপ্রথম বিদ্যালয়টি গড়ে উঠেছিল শ্রীরামপুরেই। আইনসিদ্ধ হলেও সমাজ থেকে তা কতটা সাড়া পেয়েছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিক মহলে বিতর্ক রয়েছে। অনেকেই মনে করেছেন এই স্কুলগুলি খুবই খ্যাতি লাভ করেছিল নিম্নবিত্ত ও ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান সমাজের পরিবারের মধ্যে। তাই স্কুলগুলির যে খুব আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি ছিল তেমনটা নয়। অধিকাংশ সময়ই এগুলি ছিল অবৈতনিক। ১৮৩৭ সালে জোশুয়া মার্শম্যানের প্রয়ান হলে হ্যানা মার্শম্যান অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পরেন, এবং কিছু বছরের মধ্যেই স্কুল গুলি বন্ধ হয়ে যায়। তাঁর প্রথম স্কুলটি যেটি ছিল ইউরোপীয় বাংলো শৈলীর বাড়ি, দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পরে থাকে। প্রায় নব্বই বছর পরে ১৯২৭ সালে যশস্বী শিক্ষাব্রতী স্যামুয়েল বোস স্থানীয়দের সহযোগিতায় ওই পুরোনো বাড়ি এবং নতুন জায়গা জমি নিয়ে ‘শ্রীরামপুর মিশন গালর্স হাইস্কুল’ চালু করেন। হ্যানা মার্শম্যানের কাজে উদবুদ্ধ হয়ে তিনি ওই পুরোনো বাড়িটিকে ‘Hannah House’ নামে নামকরণ করেন। বাড়িটির জীর্ণ অবস্থা হওয়ায় কিছু সময় চলার পর তাতে পঠনপাঠন বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু পাশে নতুন বাড়িতে স্কুল চলতে থাকে। বর্তমানে এটি পশ্চিমবঙ্গ উচ্চশিক্ষা দফতরের অধীন। কয়েক বছর আগে ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ ডেনমার্ক-এর প্রতিনিধি দল শ্রীরামপুর কলেজে সংরক্ষিত পুরোনো কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে বাড়িটি আবিষ্কার করেন। সম্প্রতি বাড়িটির সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে।
কেবল হুগলী জেলা তথা বাংলাই নয়, সমগ্র ভারতে স্ত্রী শিক্ষা শুরু করার এমন উদ্যোগ খুবই বিরল। ১৮৪০-৫০ এর দশকে ভারতীয়দের ত্ররফে স্ত্রী শিক্ষার আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। তার বহু দশক আগেই একজন বিদেশি মহিলার সাহস ও দৃঢ় সংকল্প সত্যিই অকল্পনীয়। এমনটা নয় যে হ্যানা মার্শম্যান কয়েকটি ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করে সমাজে বিপ্লব এনেছিলেন, সব পাল্টে দিয়েছিলেন। কিন্তু সমাজে কিছু প্রভাব তো পড়েছিল। তাঁর লড়াই থেমে যায়নি, আজও এই লড়াই চলছে এবং ভবিষ্যতেও চলবে। কিন্তু হ্যানা মার্শম্যানকে নিয়ে ‘His-story’ যেন বোবা না হয়ে যায়, আমাদের তা মনে রাখা উচিত।
Discussion about this post