পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার একটি অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শহর হল শ্রীরামপুর। একসময় ডেনিশদের বসবাস ছিল এই শহরে। এই শহর জুড়ে রয়েছে অনেক ঐতিহাসিক কাহিনী। শ্রীরামপুরের রথযাত্রা, রাধাবল্লভ মন্দির, চাতরার দোল মন্দির, শ্রীরামপুর কলেজ, শ্রীরামপুর রাজবাড়ী প্রভৃতি হল এখানকার দর্শনীয় স্থান। বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ উৎসব হল দুর্গা পুজো। শ্রীরামপুরের বিভিন্ন বনেদি বাড়িতে আজও পুরনো আমলের ধাচেঁ দুর্গা পুজো হয়। এই বনেদি বাড়িগুলির মধ্যে একটি হল শ্রীরামপুরের দে বাড়ি।
এই দে বাড়িতে প্রতি বছরই দুর্গা পুজো করা হয়। ১২১২ বঙ্গাব্দে নগেন্দ্রনাথ দে এবং পুলিনবিহারী দে এই পুজোটি শুরু করেন। শোনা যায়, মা দুর্গা নগেন্দ্রনাথ দে-কে স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন এই পুজো করার জন্য। আর তারপরেই শুরু হয় এই পুজো। প্রায় ২১৮ বছর ধরে চলে আসছে দুর্গা পুজোটি। বহু দর্শনার্থীরা এই পুজো দেখার জন্য ভিড় জমায়। এই পুজোর একটি বিশেষত্ব রয়েছে, দোল পূর্ণিমার দিন থেকে দশভূজা পূজিতা হন মহিষমর্দিনী রূপে। প্রধানত আমরা জানি, দোলপূর্ণিমাতে রাধাকৃষ্ণের পুজোই অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু শ্রীরামপুরের পঞ্চানন তলায় দোলপূর্ণিমাতে দুর্গা ঠাকুরকে মহিষমর্দিনী রূপে পুজো করার রীতি প্রচলিত রয়েছে।
আর দে বাড়ির দুর্গা প্রতিমাতেও রয়েছে একটি বিশেষত্ব। এই প্রতিমাতে দুর্গার সাথে লক্ষ্মী, গণেশ, সরস্বতী ও কার্তিকের পরিবর্তে থাকে মায়ের দুই সখী জয়া ও বিজয়া। দোলপূর্ণিমার দিন মায়ের বোধনের পর পুজো শুরু হয়। দুর্গা পুজোর সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান মেনে চারদিন ধরে পুজোটি করা হয়। বোধনের পর ষষ্ঠী-সপ্তমীর পুজো হয়। তারপরের দিন অষ্টমীর পুজো ঘটিত হয়। আর শেষ দিন নবমীর পুজো ঘটিত হয়। পুজোর চারদিন এলাকাবাসীদের বাড়িতে রান্না হয় না, তারা মায়ের ভোগ খেয়ে থাকেন। এই পুজোর আরও একটি বিশেষত্ব হল, মা দুর্গাকে যা প্রসাদ হিসেবে নিবেদন করা হয় তা সমস্ত বাড়িতে তৈরি, বাইরের কোনো খাবার মাকে নিবেদন করা হয় না। বর্তমানে এই পুজোটি পরিচালনা করে শ্রীরামপুরের টাউন ক্লাব।
এই পুজোতে বলি দেওয়ার রীতিটি পালন করা হয় না। কারন দে বাড়ির গৃহদেবতা হলেন শ্রীধর জিউ, তাই বৈষ্ণবীয় নিয়ম-রীতি মেনে এই পুজোটি নিষ্ঠার সাথে করা হয়। আগে পুজোর তিনদিন যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হত এবং কবিগানের আসর বসতো দে বাড়িতে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই রেওয়াজ এখন উঠে গেছে। তার বদলে পুজোর দিনগুলোতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দশমীর দিন মায়ের বিদায়ের পালা। এলাকাবাসী ও বাড়ির মহিলারা মেতে ওঠেন মায়ের বরণ এবং সিঁদুরখেলাতে। সাথে চলে ধুনুচি নাচ। এরপর মায়ের নিরঞ্জন করা হয় শ্রীরামপুরের বাবুঘাটে। এভাবেই পুজো শেষ হয়।
চিত্র ঋণ -জয়দেব কুন্ডু, অনুপম চক্রবর্তী
Discussion about this post