মেলা মেলা মেলা! বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মেলার যোগ-সংযোগ দীর্ঘদিনের। না না, আমি মেলা বকার কথা বলছিনা। মেলার সংজ্ঞা তো অনেক রকমের হতে পারে। আমরা যতটা বুঝি, ওই রাস্তা জুড়ে অস্থায়ী দোকান খাটিয়ে নানান জিনিস বিক্রি। আপনি আপন মনে মেলার দোকানগুলি উপভোগ করতে করতে এগোচ্ছেন। হঠাৎ সামনে রাস্তার মাঝখানে কিছু লোক দাঁড়িয়ে পড়লো। আপনি না ডানদিকে এগোতে পারছেন, না বাঁদিকে। কী বিরক্তি লাগেনা? অথবা হাঁটছেন আর আপনার জুতোটাকে পিছন থেকে কেউ পায়ে করে টেনে ধরলো। ভিড় মেলার কিন্তু এগুলোই বৈশিষ্ট্য। গুঁতোগুঁতি-ঠেলাঠেলি করে এগোতে হবেই, নাহলে সে কিসের মেলা? তার সঙ্গে জিলিপি, বাদাম ভাজা, কাটি ভাজা, গজা, খাজা, ফুচকা, ঘুঘনি, এগরোল এসবতো আছেই। এমনই চনমনে আবার ঐতিহ্যশালী এক মেলা হল, শ্রীরামপুরের শীতলা মেলা।
শ্রীরামপুরে চাতরার শীতলা মন্দিরকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় এক বিশাল মেলা। চাতরা নিবাসীদের কাছে শীতলা মায়ের পূজা দুর্গা পুজোর সমতুল্য। প্রতি বছর ফাল্গুন-চৈত্র মাসে তিথি মেনে পাঁচ দিন ধরে চলে শীতলা মায়ের আরাধনা। তবে মূল পুজো হয় অষ্টমীতে। এদিন ভক্তরা সকাল থেকে উপোস করে মায়ের বেদিতে জল ঢেলে পুজো দিয়ে ব্রত ভাঙেন। অনেকে দন্ডিও কাটেন। মন্দিরের সামনে থেকে পুজো দেওয়ার জন্য ভক্তদের লম্বা লাইন পড়ে যায়। কেবল শ্রীরামপুরই নয়! সিঙ্গুর, বড়া, বেগমপুর, উত্তরপাড়া, বালি, ডোমজুড়, হাওড়া, বর্ধমান থেকেও হাজার হাজার মানুষ এখানে আসেন।
বসন্তরোগের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শীতলা। গাধার পিঠে দেবী শীতলা ঝাঁটা ও কলসী নিয়ে বসে খাকেন। আর কুলা হচ্ছে তার মাথার অলঙ্কার। শীতল আকৃতি বিশিষ্ট বলে দেবীর নাম হয়েছে শীতলা। তাই দেবীর মূল পুজো হয় ডাবের জল দিয়ে। তবে চাতরার এই শীতলা মায়ের খাস বাংলা মুখ, সাবেকি দুর্গার আদলে নির্মিত। টানা টানা চোখ, হলুদ বর্ণা, আর সখীরা মায়ের চারপাশে। সোনার গয়নায় মাকে সাজানো হয়। দশমী পুজোর পরে মায়ের বিসর্জন হয়। আর ডাবের উপরে সিঁদুর লেপে রুপোর চোখ বসিয়ে সারা বছর মায়ের মন্দিরে পুজো হয়।
চাতরায় শীতলা মায়ের পুজো নিয়ে একটি প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে। একবার চাতরায় বসন্ত রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছিল, তারপর সেটি মহামারীর আকার নেয়। তখন সাধক রাম দাস মা শীতলার পুজো শুরু করেন। দেবী শীতলা সন্তুষ্ট হতেই চাতরা মহামারীর কবল থেকে রক্ষা পায়। ঐতিহাসিক সুধীরকুমার মিত্র মনে করেন, বাংলা সালের ১২৬০ এর দশক থেকে এখানে শীতলা দেবীর আরাধনা শুরু হয়েছিল। স্থানীয় মানুষ জন ও মন্দিরের ট্রাস্টি বোর্ড জানিয়েছেন প্রায় দুশো বছরের বেশি সময় ধরে এখানে শীতলামায়ের পুজো হচ্ছে। এই শীতলা পুজোকে কেন্দ্র করে বসা মেলা চলাকালীন এই এলাকাকে প্রায় চেনাই যায় না। সর্বত্র আলোয় সেজে ওঠে। থিকথিক করে লোক, সারিসারি দোকান বসে। খাওয়া দাওয়া, গৃহস্থালির টুকিটাকি জিনিস, বাচ্চাদের খেলনা; এসবের পাশাপাশি থাকে নাগরদোলা, মিকি মাউস তথা মনোরঞ্জনের অন্যান্য সরঞ্জাম।
তথ্যসূত্র:১) শ্রীরামপুর পরিচিতি, শ্রীরামপুর পৌরসভা, ১৪০৭ বঙ্গাব্দ২) অশোক মিত্র (সম্পাদক): পশ্চিমবঙ্গের পূজা-পার্বণ ও মেলা, দ্বিতীয় খন্ড, অনুপ্রেস, ১৯৬৮৩) সুধীরকুমার মিত্র: দেব-দেবীর কথা ও কাহিনী, ডি. এম লাইব্রেরী, ১৯৫৮৪) শ্রীরামপুরের চাতরায় ২০০ বছরের প্রাচীন শীতলামায়ের পুজো ঘিরে উৎসবের আমেজজজ, বর্তমান পত্রিকা, ২০১৯৪) প্রদীপ চক্রবর্তী: শীতলা পুজোয় মেতেছে চাতরা, এইসময়, ২০১৯
Discussion about this post