প্রকৃতির কোলে মানুষ জাতির বাস বলতে গেলেই উঠে আসে সাঁওতালদের কথা। আর সাঁওতাল সমাজের উল্লেখযোগ্য একটি বার্ষিক উৎসব হল সেঁন্দরা। উৎসব মানুষকে মিলিয়ে দেয় এ কথা কে না জানে! তবে এদের সেঁন্দরাতে চলে বন্য প্রাণীদের তলব। তাদের জীবন জীবিকা সবটাই জঙ্গলকে ঘিরে। তাই বনের এই বার্ষিক অন্বেষণ প্রক্রিয়া রূপ নিয়েছে পরবের। এ বছর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে ১৫ এবং ১৬ মে জুড়ে। কিন্তু এই ঐতিহ্য মণ্ডিত উৎসবকেই কিছু বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের কথা বলা এনজিও এবং কর্পোরেট মিডিয়া ‘শিকার উৎসব’ বলে চালায়। প্রকৃতি বাঁচাও ও আদিবাসী বাঁচাও মঞ্চের তরফে জারী এক ভিডিও বার্তায় ইতিমধ্যেই তুলে ধরা হয়েছে এই পরবের প্রকৃত স্বরূপ।
পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড় এলাকার নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চল সাঁওতালদের কাছে পবিত্র স্থান। যে এলাকা এককালে পরিচিত ছিল ‘সাঁওতাল পরগনা’ নামে। সেঁন্দরাতে গভীর জঙ্গলে অন্বেষণ দিয়ে শুরু হয় কর্মসূচি। এই সেঁন্দরা উৎসবে গভীর জঙ্গল অন্বেষণ ছাড়াও আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্ব থাকে অবশ্য। অযোধ্যা পাহাড়ের সেঁন্দরা অনুষ্ঠিত হয় সুতান টাঁডি নামক ঝোরা-সম্বলিত এক এলাকাকে কেন্দ্র করে। গভীর জঙ্গলে অন্বেষণ শেষে দলে দলে অন্বেষকেরা এখানে ফিরে এসে বিশ্রাম নেন। ধর্মীয় রীতিনীতি পালিত হয় এবং ‘ল বীর বাইসি’ নামক একটি বাৎসরিক আইনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এটি সাঁওতাল সমাজে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের গুরুত্বের সমকক্ষ বিবেচিত হয়। এখানে সাঁওতাল সমাজের থাকবন্দী বিচারব্যবস্থায় বিচার সম্পন্ন না হওয়া বিষয়গুলির নিষ্পত্তি হয়। সাঁওতাল কিশোরদের বিভিন্ন নৃত্যগীতের মাধ্যমে যৌন শিক্ষা দেওয়া হয়। আর এ জ্ঞান তাদের প্রদান করেন সাঁওতাল সমাজের বয়োঃজ্যেষ্ঠরা।
তবে বেশ কিছুদিন ধরে এ উৎসবকে শিকার পরব বলে বিকৃত করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। ১৯৭২-কে কেন্দ্র করে বনদপ্তর জঙ্গলে প্রবেশের বাধা দান করে চলেছেন। সেই সঙ্গে পরবের মধ্যে প্রবেশকারী মানুষদের সম্মানহানি করে চলেছে মিডিয়া এবং এনজিওগুলি। সেঁন্দরায় বন প্রবেশের সময় ধামসা-মাদল বাজিয়ে ঢোকা হয়, যাতে বন্যপ্রাণীর সাথে মুখোমুখি না হতে হয়। নিয়ম অনুযায়ী একান্ত কোনো বন্যপশু সামনে এসে পড়লে তখনই একমাত্র শিকার করা হয়। একটা দুটো শিকারের ঘটনাকে বিরাট আকার দেওয়ার যেন এক অনন্য প্রয়াস চলছে। এমনকি জঙ্গলের দিকে পালানো প্রাণীদের শিকারেও রয়েছে সাঁওতাল সমাজের নিষেধাজ্ঞা। তবে সেঁন্দরা মূলত জঙ্গল অভিযানের উৎসব, শিকারের নয়। এ উৎসব বন-সমাজের ভারসাম্যও বজায় রাখে বৈকি।
Discussion about this post