ভারত মূলতঃ এক ঐতিহ্যবাহী দেশ। আমাদের দেশের প্রাচীন স্হাপত্যগুলি বিশ্বের কাছে বরাবরই এক আর্কষণের বিষয় হয়ে রয়েছে। বিশেষত মন্দিরগুলির মধ্যে এই প্রাচীন স্হাপত্যের বিশেষ নিদর্শন পাওয়া যায়। এই প্রাচীন স্থাপত্যগুলির মধ্যেই লুকিয়ে আছে সেই সময়ের সমাজ ব্যবস্থা, শিল্প এবং জীবনযাত্রার প্রেক্ষাপট। সেই অনুযায়ী আমাদের প্রতিটি মন্দিরই এক একটি সময়কালের ইতিহাস তুলে ধরে আমাদের সামনে। তেমনই একটি মন্দির হল বর্ধমান জেলার বিখ্যাত সর্বমঙ্গলা বাড়ি।
চলুন জেনে নেওয়া যাক এই মন্দিরের ইতিহাস। বর্ধমানের ডি.এন রোডে ১৭০২ খ্রিষ্টাব্দে মহারাজা কীর্তিচাঁদ দ্বারা নির্মিত তারকেশ্বর, রামেশ্বর, কমলেশ্বর ও চন্দ্রেশ্বর শিব মন্দির সহ সর্বমঙ্গলা মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। অবিভক্ত বাংলার প্রথম নবরত্ন মন্দির হিসাবে এই মন্দিরটি পরিচিত। সেক্ষেত্রে বোঝাই যায় এর গুরুত্ব ঠিক কতখানি। এই মন্দিরে অধিষ্ঠিত দেবী মূর্তিটিও আনুমানিক হাজার বছর পুরনো। এমনকি বেশ কিছু পুরনো সাহিত্য ও পবিত্র গ্রন্থেও পাওয়া যায় এই দেবীর উল্লেখ।
পরবর্তীকালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে বর্ধমানের তৎকালীন রাজা স্যার উদয়চাঁদ ১৯৫৯ সালে একটি ট্রাস্ট গঠন করেন। সেই সময় থেকেই এই ট্রাস্ট বোর্ড মন্দির পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন। এরপর ১৯৯৪ সাল থেকে ভক্তদের ও স্বনামধন্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্টানগুলির সহায়তায় ট্রাস্ট বোর্ড মূল মন্দিরের সংস্কার করে এক নতুন রূপ দেওয়া থেকে শুরু করেন। ফলস্বরূপ নতুন ভোগ ঘর থেকে শুরু করে ভক্তদের জন্য দৈনিক ভোগের ব্যবস্থা, শিবমন্দিরগুলি সংস্কার, মন্দির প্রাঙ্গণে বড় ফোয়ারা সহ সুন্দর বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এমনকি একটি নাটমন্দিরও দিনের আলো দেখেছে যার পরিমাপ প্রায় পাঁচ হাজার বর্গফুট। এছাড়াও রয়েছে ভক্তদের জন্য যাত্রী নিবাস, পানীয় জল, টেলিফোন, টয়লেট এমনকি যানবাহন পার্কিংয়ের সুবিধাও রয়েছে।
কথায় আছে, “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।” সেই বিশ্বাসের ওপর ভর করেই প্রতিদিন প্রচুর সংখ্যায় ভক্তদের আগমন ঘটে মন্দিরে। শুধু বর্ধমান নয়, বাইরে থেকেও প্রচুর ভক্তরা আসেন মন্দির প্রাঙ্গণে। বিশেষতঃ বাংলার নববর্ষ, বিপত্তারিণী পুজো, দুর্গা পুজো, কালী পুজো, নবান্ন এবং শিবরাত্রির দিন ভিড় যেন উপচে পরে। এছাড়াও মন্দিরে রয়েছে বিয়ের ব্যবস্থা। তার জন্য হাতে একটু সময় নিয়েই মন্দির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে নিতে হয়। তৎকালীন বাংলার জনপ্রিয় টেরাকোটার ছাপও দেখা যায় মন্দিরের কাঠামোতে। ঐতিহাসিকরাও মন্দিরের প্রাচীনতাকে যথেষ্টই গুরুত্ব দিয়েছেন। একই সাথে জেলা প্রশাসন এবং পৌরসভা মন্দির ও তার আশপাশের জায়গার উন্নয়নে সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
ঈশ্বর বিশ্বাসীদের সাথে সাথে ঈশ্বরে বিশ্বাসী নন তারাও এই প্রাচীন মন্দিরে ঘুরে আসতেই পারেন। কারন মন্দিরের গায়ে ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন নিখুঁত টেরাকোটা শিল্পকর্ম দেখে নিরাশ হবেন না। ফেরার সময় বিখ্যাত বর্ধমানে সীতাভোগ মিহিদানা না খেলে কিন্তু চরম মিস!
চিত্র ঋণ – চিরঞ্জিৎ চ্যাটার্জী
Discussion about this post