দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজীর ভূমিকা সম্পর্কে অবগত নন, এমন বাঙালি বিরল। কিন্তু সেই একই পরিবারেই যে জন্মেছিলেন অন্যতম আর এক স্বাধীনতা কর্মী, তা বোধহয় আমরা অনেকেই জানি না। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদানও কোন অংশে কম ছিল না। পাশাপাশি তিনি ছিলেন বাংলার এমন একজন রাজনীতিবিদও, যিনি বঙ্গভঙ্গের ঐতিহাসিক পটভূমিকায় নিজের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার যথেষ্ট প্রমাণ রেখেছিলেন। বাংলা ভাগ রুখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন মানুষটি। তিনি সম্পর্কে নেতাজীর মেজ ভাই, ব্যারিস্টার শরৎচন্দ্র বসু!
ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের তিনি ছিলেন এক নৈতিক সমর্থক। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের হয়ে আদালতে বিনা পারিশ্রমিকে লড়তেন। ভাইয়ের ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী (INA) গঠনের দৃঢ় সমর্থক ছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, পরবর্তীতে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণও করেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ্য দলে যুক্ত হয়ে তাঁর রাজনীতিতে অভিষেক ঘটে। এরপর ১৯৩৬ সালে তিনি প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসের কার্যনির্বাহী সমিতির সদস্য হিসাবে কাজ করেছেন। তবে রাজনীতিবিদ হিসাবে তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা।
একজন দেশপ্রেমিক বাঙালি হিসাবে বরাবর তিনি সমাজ ও ভাষার ভিত্তিতে গঠিত স্বশাসিত সমাজতান্ত্রিক রাজ্যের সমন্বয়ে একটি অখণ্ড ভারত গঠনের পক্ষে থেকেছেন। তৎকালীন পরিস্থিতিতে কাজটি নেহাতই সহজ ছিল না। ঘটনার প্রেক্ষাপট ১৯৪৫ সালে নেতাজীর শেষবার জনসমক্ষে আসার বছর দুয়েক পর। ১৯৪৬ সালে কলকাতার বুকে ঘটে যাওয়া দাঙ্গার ক্ষত তখনও দগদগে। এমন পরিস্থিতিতে একদিকে তখন ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বাংলা ভাগের সমর্থনে সারা বাংলায় হিন্দু সমাবেশ হচ্ছে, আর অপরদিকে বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে এবং স্বাধীন যুক্তবঙ্গের দাবিতে মুসলিম লিগ, মহাত্মা গান্ধী, বাংলা কংগ্রেসের একাংশ এবং শরৎচন্দ্র বসু – সকলে একজোট হয়ে গিয়েছেন। দীর্ঘদিনের অসুস্থতাকে উপেক্ষা করে শরৎবাবু স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মুসলমানপ্রধান স্বাধীন বঙ্গভূমির সংবিধান রচনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। উনি জানিয়েছিলেন, দেশে সংবিধান সমিতির ৩০ জন সদস্য থাকবেন, যার মধ্যে ১৬ জন মুসলমান ও ১৪ জন হিন্দু। হিন্দু ও মুসলমান মন্ত্রী থাকবেন সমসংখ্যক, প্রধানমন্ত্রী হবেন মুসলমান এবং গৃহমন্ত্রী হিন্দু। তাছাড়া স্বাধীন বঙ্গভূমির সরকারি সহায়তার ওপর মুসলমানদের নিরবিচ্ছিন্ন অধিকার থাকবে। এ নিয়ে হাসি-ঠাট্টাও কম হয়নি। কিন্তু শরৎবাবু মনে-প্রাণে সমাজতান্ত্রিক ছিলেন, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়তে চেয়েছিলেন সমাজতন্ত্র দিয়ে। ওঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, স্বাধীন অবিভক্ত বঙ্গভূমি হবে একটি সোশ্যালিস্ট রিপাব্লিক।
পরবর্তী ঘটনা তো সকলেরই জানা। দেশভাগ হয়ে খণ্ডিত হল বাংলাও। টুকরো টুকরো হয়ে গেল শরৎচন্দ্র বসুর স্বপ্ন। সেই স্বপ্নভঙ্গের আঘাতেই হয়তো স্মৃতির অগোচরে চলে গিয়েছিলেন মানুষটি! এই মহান রাজনীতিবিদকে স্মরণে রাখতে হাইকোর্টের সামনে তাঁর একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। কলকাতার একটি মুখ্য রাস্তাও আজ ওঁর নামাঙ্কিত। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইতিহাসবিদ লিওনার্ড এ গর্ডন, শরৎচন্দ্র বসু ও তাঁর ভাই সুভাষচন্দ্র বসুর একটি যৌথ জীবনী লিখেছেন, যার নাম ‘ব্রাদার্স এগেইনস্ট দ্য রাজ’। হতে পারে বাস্তবায়িত হয়নি তাঁর স্বপ্ন, তবুও আপামর বাঙালির আবেগ ও দেশপ্রেমের পক্ষ নেওয়ার জন্য ভারতের এই দৃঢ়চেতা সন্তানকে জানাই কুর্নিশ!
Discussion about this post