দশমীর দিন সিঁদুর খেলার বরাবরই রীতি রয়েছে বাঙালিদের মধ্যে। প্রতিমা বিসর্জনের ঠিক আগে দেবীকে বরণ করে, মিষ্টি মুখ করিয়ে শুরু হয় সিঁদুর খেলা। বলা যায়, দশমীর একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল সিঁদুর খেলা। কিন্তু অষ্টমীতে সিঁদুর খেলা! কি ভাবছেন তো এটাও হয়? হ্যাঁ একদম হয়। প্রত্যেকটা বনেদি বাড়ির পুজোরই নিজস্ব কিছু রীতি রেওয়াজ রয়েছে। এগুলোই সেই পুজোর বিশেষত্ব। বংশ পরম্পরায় এই ঐতিহ্যকেই বয়ে নিয়ে চলেছে সেসব বাড়ির বংশধরেরা। ঠিক তেমনই খুব পরিচিত এক বনেদি বাড়ির পুজো হল হাওড়া জেলার সাঁকরাইল অঞ্চলের রাজগঞ্জের পাল বাড়ির দুর্গা পুজো। রীতি, আচার ও অভিনবত্বে এ বাড়ির পুজো অনন্য।
সাঁকরাইলের পালবাড়ির পুজো শুধু হাওড়ার নয়, গোটা রাজ্যেরই অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যশালী পুজো। নয় নয় করে এই পুজোর বয়স হল তা প্রায় ২০০ বছর। পরিবার সূত্রে জানা যায় এই বাড়ির প্রাণপুরুষ রাজা রাম পাল ছিলেন আন্দুল রাজবাড়ির দেওয়ান। ভালো কাজের জন্য রাজার থেকে বেশ কিছুটা জমি পেয়ে রাজগঞ্জে গঙ্গার পাড়ে একটি বাড়ি তৈরি করেন। সে বাড়ি অবশ্য ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গঙ্গায় তলিয়ে যায়। এরপর ১৮২০ সালে রাজারাম পালের বংশধর চূড়ামণি পাল সেই বাড়ির কাছেই গঙ্গার পাড়ে তৈরি করান বিশাল অট্টালিকা। গোল গম্বুজ দিয়ে ঘেরা, সাথে মাঝ উঠোনে খোলা দুর্গা দালান, যা আজও জানান দিচ্ছে পুরনো সেই ঐতিহ্যের কথা। বাড়ির আনাচে-কানাচে কান পাতলে শোনা যায় তখনকার দিনের সেই রাজকীয় কাহিনী। নতুন বাড়ির নাম রেখেছিলেন ‘ললিত লজ’। সেই সময় থেকেই পালবাড়িতে শুরু হয় দুর্গাপুজো যা আজও ঐতিহ্যের সঙ্গে চলে আসছে।
জন্মাষ্টমীর দিন দেবীর কাঠামো পুজো করে একচালার দুর্গা প্রতিমা বাড়ির ঠাকুরদালানেই তৈরি হয়। মহালয়ার দিন মঙ্গল ঘট স্থাপন করে সূচনা হয় পুজোর। ষষ্ঠীতে দেবীর বোধন থেকে শুরু করে সেই দশমী অবধি পুরো পুজোটাই হয় বৈষ্ণব মতে। এ পুজোয় বলিপ্রথা নিষিদ্ধ। অষ্টমীতে মাকে বিশেষ ভোগ নিবেদন করা হয়। এ বাড়ির পুজোর অন্যতম আকর্ষণ সিঁদুরখেলা। এই সিঁদুরখেলার মধ্যেই লুকিয়ে সাঁকরাইলের পালবাড়ির বনেদিয়ানার ঐতিহ্য। বাড়ির প্রথা অনুযায়ী দশমীতে মা চলে যাবার বিষাদে বাড়ির মহিলারা সিঁদুর খেলতে না চাওয়ায় পুরনো ঐতিহ্য মেনে আজও সিঁদুর খেলা হয় অষ্টমীতেই। দশমীর দিন দেবীকে কাঁধে করে নিয়ে গিয়ে গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়ার রীতি।
পালবাড়ির পুজো যাতে সুষ্ঠুভাবে বছরের পর বছর তাদের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে পারে সেই কারণে পূর্বপুরুষরাই হাওড়া আন্দুলের একটি বিশাল জমি দেবোত্তর সম্পত্তি করে ট্রাস্ট তৈরি করে দিয়ে যান। সেই ট্রাস্টের আয় থেকে বহন করা হয় দুর্গাপুজো ও বাড়ির অন্যান্য পুজোর খরচ। তবে অর্থের প্রতিপত্তি এখনও টিকে থাকলেও লোকবলে বেশ ভাটা পড়েছে। চাকরি বা কর্মসূত্রে এখন পরিবারের অধিকাংশ সদস্যরাই থাকেন দেশে-বিদেশে। পুজোর কয়েকটা দিন অবশ্য তারা ছুটে আসেন বাড়ির পুজোর ঐতিহ্যের টানে।পুজোর দিনগুলোয় ঐতিহ্য মেনে অক্ষরে অক্ষরে মানা হয় পারিবারিক রীতিনীতি।
চিত্র ও তথ্য ঋণ – সন্ধ্যা দে
Discussion about this post