একই পরিবারের দু’ভাই যখন শান্তিতে থাকে, তখন বলি, ভাইয়েদের মধ্যে সম্প্রীতি আছে। তেমনই হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষ যখন পড়শীজ্ঞানে মিলেমিশে বসবাস করে, তখন বলি, দেশে সম্প্রীতি আছে। কিন্তু এমন নির্দশন খুব কমই লক্ষ্য করা যায়। হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির নির্দশন দেখা যায় মহারাষ্ট্রের ওসমানাবাদ জেলার কালাম্ব ব্লকের একটি ২০০ বছরের প্রচীন দরগায়। এটি হল মোহা গাঁয়ের হজরত সৈয়দ আলবি দরগা। এখানকার একটি বিশেষ পরব হল কান্দুরি। প্রধানত গ্রীষ্মের মাস গুলিতেই ছুটি পায় চাষি পরিবারগুলি। আর তখনই ওসমানাবাদ, জালনা, ঔরঙ্গাবাদ, হিঙ্গোলি, বীড, লাতুর, পারভানি ও নান্দেড় – মারাঠাওয়াড়ার এই আটটি জেলা জুড়ে পীরের দরগাগুলি জমজমাট হয়ে ওঠে।

মোহা গাঁয়ের এই দরগায় মে মাসের তপ্ত গুমোট বিকেল বেলাতেও লোকে লোকারণ্য থাকে। বাৎসরিক পুজোপাঠ ও ভোগের জন্য লাইন পড়ে, আর সেই লাইনে মুসলমানের চাইতে হিন্দুদের সংখ্যাই বেশি থাকে। প্রতি বৃহস্পতিবার ও রবিবার করে এখানে এসে হাজির হয় কয়েকশো পরিবার। মদ্দা ছাগল কুরবানি দিয়ে, রান্না মাংসের নৈবেদ্য চড়িয়ে, দোয়া চেয়ে, একসঙ্গে পাত পেড়ে খেয়ে ও অন্যদের খাইয়ে পুণ্য অর্জন করেন বিশ্বাসী মানুষজন। এই মাজারে প্রতিটি গাছ, প্রতিটি টিনের চালা ও ত্রিপল-ছাউনির তলায় উনুন জ্বালিয়ে রান্না করে লোকে। দরদায় পুজোপাঠের সময় নিবেদন করা হয় এই খাবার। এই মাজারে রান্নার ক্ষেত্রে একটি বিশেষত্ব চোখে পড়ার মতো, কান্দুরি ভোজের গোস্ত শুধুমাত্র পুরুষরাই রান্না করেন।

এখানে অসংখ্য মহিলা মাঝরাত থেকে দুচোখের পাতা এক না করে বাৎসরিক কান্দুরি ভোগ তৈরির কাজ করেন। এখানে মাংস আর ভাকরি নামে এক প্রকারের রুটি রান্না করা হয়। তবে এদের অনেকেই বৃহস্পতিবারে নিরামিষ ছাড়া কিছু মুখে দেন না। কিন্তু এখানে একই উনুনে মাংস রান্না হয় এবং সেখানেই নিরামিষ খাবার রান্না হয় আবার একই থালায় খাওয়া হয়। তাতে কিন্তু কারোর অনুভূতিতে আঘাত লাগে না বা কারোর মনে কোনও ক্ষোভ জমা হয় না। দরগার মুজাওয়রকে নৈবেদ্য বা নিভাদ স্বরূপ পাঁচটি ভাকরি, বাছাই করে তুলে রাখা মাংসের টুকরো সহ হাঁড়ি ভর্তি ঝোল এবং গমের গুঁড়ি, চিনি কিংবা গুড় ও ঘি দিয়ে বানানো একধরনের মিষ্টি (মালিদা) নিবেদন করা হয়। নৈবেদ্য চড়াতে দরগায় কাছে যান পুরুষেরা। আর মাজারের বাইরে সিঁড়িতে বসে তা দেখতে দেখতে দোয়া চাইতে থাকেন মহিলারা। এখানেও মহিলারা মন্দিরের মতোই শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথা ঢেকে বসেন।

দোয়া ও উপহার দেওয়া-নেওয়ার পালা শেষ হলে শুরু হয় মহাভোজ। দরগায় কর্মরত পাঁচ ফকির ও পাঁচ নারী না খাওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে খাওয়া-দাওয়া। মাজারের পিছন দিকে ধাতব বেড়ার গায়ে বাঁধা থাকে অসংখ্য নিয়ন ও হালকা সবুজ রঙের কাঁচের চুড়ি। সব ধর্মের মায়েরাই ভালো জামাই পাওয়ার আশায় বেঁধে রাখে এগুলি। মাজার চত্বরের এক পাশে একটি বৃহদাকারের কাঠের ঘোড়ার সামনে সাজানো থাকে কয়েকটি পোড়ামাটির ঘোড়া। পরম পূজ্য মুসলমান সন্তরা জীবিতাবস্থায় ঘোড়া চড়তেন, তাই এই ভেটগুলি তাঁদের স্মৃতিতেই দেওয়া হয় বলে জানা যায়।
চিত্র ঋণ – Rural India Online







































Discussion about this post