“আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগেকার সত্তর হাজার টাকার বর্তমান মূল্য কত হতে পারে ধারণা আছে? সত্তর হাজার! তখনকার দিনের প্রায় সত্তর হাজার টাকার সোনা-দানা, মণি-রত্ন লুঠ করেছিল ওই বদমাশ ক্লাইভ এই চন্দননগরের নন্দদুলাল মন্দির লুঠ করে, যা কাজে লাগিয়েই তো ইংরেজরা পলাশীতে জিততে পেরেছিল!” – কথাগুলো বলছিলেন চন্দননগরের এক প্রবীণ বাসিন্দা, বাপ্-ঠাকুরদার কাছে শুনে আসা এই পুরোনো শহরের ইতিহাস শোনাতে গিয়ে। কিন্তু কোথায় পলাশীর যুদ্ধ, আর কোথায়ই বা চন্দননগর – আর এই নন্দদুলাল মন্দির আর তার লুঠ হওয়া সম্পত্তির হিসাবই বা কোথা থেকে এলো! এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় আড়াইশো বছর আগে।
আমরা সকলেই জানি, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লা-কে পরাজিত করে বাংলায় কোম্পানি রাজত্বের সূচনা করে। এই পলাশী যুদ্ধের আগের বছর, ১৭৫৬ সালে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্রিটিশ ও ফরাসীদের মধ্যে শুরু হয় সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের, যার রেশ এসে পড়ে বাংলা তথা সমগ্র ভারতবৰ্ষতেই।বাদ যায়নি বাংলায় ফরাসীদের উপনিবেশ চন্দননগরও ,পলাশী আক্রমণের তিনমাস আগে হঠাৎই ২৩ মার্চ, ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চন্দননগর আক্রমণ ও দখল করে। কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ স্থলপথে সৈন্যবাহিনী নিয়ে ও এডমিরাল চার্লস ওয়াটসন জলপথে তিনটি যুদ্ধজাহাজ নিয়ে চন্দননগরে হামলা করেন ও ফরাসীদের শাসন ও বাণিজ্য ব্যবস্থার মেরুদন্ড ভেঙে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সমগ্র চন্দননগর জুড়ে যথেচ্ছভাবে লুঠতরাজ ও ধ্বংসলীলা চালান। তবে এই আক্রমণ কি শুধুই ছিল সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের ফলাফল? উত্তরটা অবশ্যই না।বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে, এই আক্রমণ আসলে ছিল ব্রিটিশদের একটি সুচতুর এবং সুকৌশলী পদক্ষেপ । এই পদক্ষেপ পরবর্তীকালে পলাশীর যুদ্ধে তাদের বাংলার নবাবের বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল। নবাবের দ্বারা আরোপিত বিভিন্ন বাণিজ্যিক শর্ত, বিধি-নিষেধ, কলিকাতা আক্রমণ ও দখল, অন্ধকূপ হত্যা – প্রভৃতি কারণে ব্রিটিশরা এমনিতেই প্রতিশোধ স্পৃহাতে ফুঁসছিলো।
অন্যদিকে, ব্রিটিশ কোম্পানির অন্যতম প্রাণপুরুষ রবার্ট ক্লাইভ বাংলায় আসার আগে কর্ণাটকে ফরাসীদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, যা তাঁর মনে উদ্রেক করেছিল প্রবল ফরাসী-বিদ্বেষ। এই ফরাসীরাই আবার বাংলায় নবাব- ঘনিষ্ঠ হিসাবে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছিলো, যা ক্লাইভসহ ব্রিটিশদের যথেষ্ট ঈর্ষাণ্বিত করে তোলে। এছাড়াও, ক্লাইভ এবং ওয়াটসন সহ ব্রিটিশ আধিকারিকরা অনুমান করে দেখেছিলেন, যদি কোনোভাবে ব্রিটিশরা পলাশী আক্রমণ করে নবাবের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে, তবে বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্য কেউ আটকাতে পারবে না। কিন্তু এই জয়ের পথের কাঁটা হয়ে উঠতে পারে ফরাসীরা, কারণ নবাবের সাথে সুসম্পর্ক থাকার ফলে নিশ্চিতভাবেই তারা যুদ্ধে নবাবকে অস্ত্রশস্ত্র ও সৈন্যদল দিয়ে সাহায্য করবে।
তবে সবচেয়ে চিন্তার বিষয় ছিল যেটা, সেটা হলো, পলাশী বিজয়ের পর ব্রিটিশদের নদী মারফত কলিকাতা ফেরার পথে চন্দননগর অতিক্রম করার মুহূর্তে অনিবার্যভাবেই ফরাসী আক্রমণের সম্মুখীন হতে হবে।তখন ফরাসীদের কাছে হেরে গেলে পলাশী তো দূর, পাততাড়ি গোটাতে হতে পারে সাধের কলিকাতা থেকেও। তার থেকে বরং শুরুতেই চন্দননগর দখল করে নষ্ট করে দেওয়া যাক ফরাসীদের সমস্ত বাড়বাড়ন্ত। এর ফলে ফরাসীরা তো নবাবকে সাহায্য করতে পারবে না-ই , উল্টে ফরাসী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যও ভালোমতো ধাক্কা খাবে, কারণ পন্ডিচেরির পর চন্দননগরই ছিল ফরাসীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক উপনিবেশ। পরিকল্পনামাফিক, ২৩শে মার্চ, ১৭৫৭ সালে দেওয়া হলো এই মাস্টারস্ট্রোক। চন্দননগর আক্রমণ করে ব্রিটিশরা প্রথমেই ক্ষতিগ্রস্ত করে ফরাসী দুর্গ ‘ফোর্ট দ্যা অরলেয়া’। এছাড়াও ধ্বংস করে দেওয়া হয় ফরাসী ও স্থানীয় অভিজাতদের বিভিন্ন সম্পত্তি ও বাসভবন। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় শহরের অন্যতম প্রাণপুরুষ ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর প্রাসাদোপম অট্টালিকা। ইন্দ্রনারায়ণের তৈরী সুদৃশ্য ও সুবৃহৎ নন্দদুলাল জীউ-র মন্দিরটি কামানের গোলা দিয়ে ধূলিসাৎ করার চেষ্টা চালানো হয়, আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়নি বিগ্রহটিও। আজও চন্দননগর মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে এই বিগ্রহটির ভগ্নাবশেষ।
এখনও এই শহরের কিছু প্রবীণ নাগরিক বিশ্বাস করেন যে ইন্দ্রনারায়ণের তৈরী এই মন্দির লুঠ করেই ব্রিটিশরা জোগাড় করেছিল পলাশী জয়ের প্রয়োজনীয় অর্থ। তারা আরো বিশ্বাস করেন, যদি ব্রিটিশরা পলাশীতে পরাজিত হতো, তবে পরবর্তীকালে ব্রিটিশ কলকাতা নয়, ফরাসী চন্দননগরই হয়ে উঠতে পারতো বাংলা তথা ভারতের অন্যতম একটি সমৃদ্ধশালী শহর। বর্তমানের ছোট্ট, ঘুমন্ত এই শহরটির এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্ম তাদের বুকে করে বয়ে নিয়ে চলেছে এই আফসোসের গল্প । ফরাসী সুগন্ধের সেই সুদিন আর না থাকলেও শহরের পুরোনো অলিগলিতে কান পাতলে আজও হয়তো শোনা যাবে কিছু অভিমানী দীর্ঘশ্বাস।
Discussion about this post